![]() |
ছদ্মবেশে চিলেতে |
গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের লেখা "ছদ্মবেশে চিলেতে" একটি অতুলনীয় রিপোর্টাজ যা চিলির চলচ্চিত্র পরিচালক মিগুয়েল লিতিন এর জীবন এবং কর্ম নিয়ে গভীর পর্যবেক্ষণ প্রদান করে। এই বইটি মূলত মার্কেজের নন-ফিকশন প্রকারের একটি কাজ, যেখানে তিনি লিতিনের চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রক্রিয়া, রাজনৈতিক চেতনাবোধ এবং তার সাহসী সংগ্রামের গল্প তুলে ধরেছেন। এখানে মার্কেজ, একজন অভিজ্ঞ সাংবাদিক হিসেবে, চিলির রাজনৈতিক ইতিহাস এবং সামরিক শাসনের প্রেক্ষাপটে লিতিনের চলচ্চিত্র নির্মাণের কাহিনি উপস্থাপন করেছেন।
মিগুয়েল লিতিন একজন বিখ্যাত চিলিয়ান চলচ্চিত্র পরিচালক, যিনি ১৯৭৩ সালে চিলিতে সামরিক অভ্যুত্থান হওয়ার পর রাজনৈতিক কারণে দেশ থেকে নির্বাসিত হন। লিতিনের চলচ্চিত্র নির্মাণে বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়েছে তার রাজনৈতিক সচেতনতা এবং দেশের প্রতি এক গভীর ভালোবাসা। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তার প্রতিরোধমূলক কর্মকাণ্ড এবং চিলির জনগণের প্রতি তার সাহসী দৃষ্টিভঙ্গি এক অনন্য উদাহরণ হিসেবে পরিগণিত। মার্কেজ এই বইয়ে লিতিনের কাজকে একটি প্রতিবাদী ও সাহসিকতার গল্প হিসেবে চিত্রিত করেছেন, যা রাজনৈতিক দমন-পীড়ন এবং সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সাহসী প্রতিক্রিয়া জানানোর একটি মাইলফলক।
১৯৭৩ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর, চিলিতে কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে অনেক শিল্পী ও চলচ্চিত্র নির্মাতা তাদের কাজের মাধ্যমে সরকারের প্রতি আপত্তি জানাতে শুরু করেন। মিগুয়েল লিতিন তার চলচ্চিত্রের মাধ্যমে জনগণের অসন্তোষ এবং শাসকগোষ্ঠীর দমনমূলক আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে চেষ্টা করেন। মার্কেজ তার বইতে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ব্যাখ্যা করেছেন কিভাবে লিতিন এই পরিস্থিতির মধ্যে কাজ করেছেন এবং তার চলচ্চিত্র নির্মাণের পদ্ধতিতে রাজনৈতিক সচেতনতা এবং স্বাধীনতার প্রতি তার আকাঙ্ক্ষা কতটা প্রকট হয়ে উঠেছিল।
লিতিনের চলচ্চিত্রে, বিশেষত "El Chacal de Nahueltoro" (১৯৭০) এর মতো সিনেমাগুলোর মধ্যে গভীর সামাজিক এবং রাজনৈতিক বার্তা ছিল, যা শাসকগোষ্ঠীর কর্মকাণ্ডের প্রতি এক ধরনের নীরব কিন্তু শক্তিশালী প্রতিবাদ ছিল। মার্কেজ এই বইতে ঠিক সেই মুহূর্তগুলো তুলে ধরেছেন, যখন লিতিন তার চলচ্চিত্রের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে বিদ্যমান অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতার গল্প বলেছিলেন।
লিতিনের সিনেমাগুলো শাসকগোষ্ঠীর নজর এড়িয়ে নির্মাণ করতে হয়েছে, এবং এই চ্যালেঞ্জের মধ্যে ছিল বিপুল সাহসিকতা। সামরিক শাসনের অধীনে, যখন শিল্পীদের ও নির্মাতাদের উপর ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল, তখন লিতিন তার চলচ্চিত্রের জন্য এক ছদ্মবেশ ধারণ করেন। মার্কেজ তার বইতে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে চিত্রিত করেছেন, কিভাবে লিতিন তার চলচ্চিত্রের শুটিংয়ের জন্য গোপনে চিলির বিভিন্ন অঞ্চল ভ্রমণ করেছিলেন এবং কিভাবে তিনি নিজের পরিচয় গোপন রেখে সাহসিকতার সাথে কাজ করেছেন।
মার্কেজের লেখায় লিতিনের সংগ্রাম শুধু একটি রাজনৈতিক পরিস্থিতি বা শিল্পী জীবনের কথা নয়, বরং মানবাধিকার, স্বাধীনতা এবং সাহসের প্রতি এক অটল আনুগত্যের প্রতিচ্ছবি। বইটির মাধ্যমে মার্কেজ পাঠকদের দেখান কিভাবে লিতিনের চলচ্চিত্র শুধুমাত্র একটি শিল্পকর্ম নয়, বরং একটি প্রতিবাদী মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছে, যেখানে শিল্পীর একাগ্রতা, দেশপ্রেম এবং মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা প্রতিফলিত হয়েছে।
লিতিন, যিনি নির্বাসনে ছিলেন এবং তার দেশ থেকে দূরে ছিলেন, তার চলচ্চিত্র নির্মাণের মাধ্যমেই নিজেকে প্রকাশ করতে পেরেছিলেন। এই রচনাটি শুধুমাত্র চলচ্চিত্র শিল্পের ইতিহাস নয়, বরং একটি জাতির সাহসী সংগ্রামের দলিল। মার্কেজ এই বইয়ে লিখেছেন যে, লিতিনের কাজের মাধ্যমে তিনি শুধুমাত্র চলচ্চিত্রকেই নয়, বরং তার সমাজ এবং দেশের প্রতি দায়বদ্ধতাকেও তুলে ধরেছেন।
"ছদ্মবেশে চিলেতে" একটি শক্তিশালী ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্লেষণ যা শুধুমাত্র একটি চলচ্চিত্র নির্মাতার জীবনের কাহিনি নয়, বরং এক দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, তার চিরন্তন শৈলী ও গভীর অন্তর্দৃষ্টির মাধ্যমে, লিতিনের সংগ্রাম, সাহস এবং চলচ্চিত্র নির্মাণের ইতিহাসকে চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন। এটি একটি প্রতিবাদী শিল্পীর সংগ্রামের আত্মকথা, যেখানে সাহস, স্বাধীনতা এবং মানুষের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা প্রধান বিষয় হিসেবে উঠে এসেছে।
রিভিউ: রওনক জাহান মুন