ফুলগুলো সরিয়ে নাও, আমার লাগছে !

 


মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পরে তাকে শ্রদ্ধা জানতে আসে হাজার হাজার মানুষ। কফিনে ফুলের স্তুপ দেখে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন:-


ফুলগুলো সরিয়ে নাও,

আমার লাগছে। "


মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বেঁচে ছিলেন দারিদ্রতার সাথে যুদ্ধ করে। অনিশ্চয়তা আর অর্থকষ্ট ছিলো তার নিত্য দিনের সঙ্গী। মার্কসবাদে বিশ্বাসী মানিক তথা প্রবোধ বসবাস করতেন দারিদ্র্য সীমানা নিচে। জীবনের দুঃখ দারিদ্র্য তাকে দুমুঠো অন্ন দেয়নি ঠিকমতো। জীবনের গ্লানি তাকে বলতে বাধ্য করেছিলো,  "দুটি ডাল-ভাতের সংস্থান না রেখে বাংলাদেশে কেউ যেন সাহিত্য করতে না আসে"।


মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তাকে হাসপাতালে নিতে হবে। কিন্তু ঘর তো শুন্য, তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়াও কঠিন। দারিদ্র্য তখন ভয়াল এক দানবের মতো আসন গেড়ে বসেছে তাঁর সংসারে। বন্ধু কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়সহ আরো কয়েকজন এসেছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে হাসপাতালে নিয়ে যেতে। নিয়ে যাওয়ার সময় ‘‌সুভাষ মুখোপাধ্যায় মানিকবাবুর স্ত্রীকে অভিযোগ করে বলেছিলেন: এমন অবস্থা টেলিফোন করেননি কেন? উত্তরে কমলা বন্দ্যোপাধ্যায় অস্ফুটে বলে ফেলেছিলেন: তাতে যে পাঁচ আনা পয়সা লাগে ভাই।’


স্বাস্থ্য ক্ষয় হতে হতে মানিক পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পাড়ি জমালেন পরকালে। লোকমুখে খবর ছড়ালো। মানুষজন ফুলের তোড়া নিয়ে ভীড় করতে লাগলেন। কফিনের উপর ফুলের স্তুপ জমতে লাগলো। এত ফুল হয়েছিলো যে ট্রাক ভাড়া করে ফুল সরাতে হয়েছিলো। যত ফুল মানিকের কফিনের উপর জমেছিলো তার অর্থ দিয়ে অনায়াসে তার চিকিৎসা করা যেতো, অথবা আরো ছয় মাস দুমুঠো খেয়ে বেঁচে থাকতে পারতেন। 

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পরে কফিনের উপর ফুলের স্তুপ দেখে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় ' পাথরের ফুল নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন।



কবিতা:-

---------------


পাথরের ফুল

সুভাষ মুখোপাধ্যায়



ফুলগুলো সরিয়ে নাও,

আমার লাগছে।

মালা জমে জমে পাহাড় হয়

ফুল জমতে জমতে পাথর।

পাথরটা সরিয়ে নাও,

আমার লাগছে।

এখন আর

আমি সেই দশাসই জোয়ান নই।

রোদ না, জল না,হাওয়া না--

এ শরীরে আর

কিছুই সয় না।

মনে রেখো

এখন আমি মা-র আদুরে ছেলে--

একটুতেই গলে যাবো।

যাবো বলে

সেই কোন সকালে বেরিয়েছি--

উঠতে উঠতে সন্ধে হল।

রাস্তায় আর কেন আমায় দাঁড় করাও?

অনেকক্ষণ থেমে থাকার পর

গাড়ি এখন ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে চলছে।

মোড়ে ফুলের দোকানে ভিড়।

লোকটা আজ কার মুখ দেখে উঠেছিল?



ঠিক যা ভেবেছিলাম

হুবহু মিলে গেল।

সেই ধূপ, সেই ধুনো, সেই মালা, সেই মিছিল--

রাত পোহালে

সভা-টভাও হবে।

(একমাত্র ফুলের গলা-জড়ানো কাগজে লেখা

নামগুলো বাদে)

সমস্তই হুবহু মিলে গেল।

মনগুলো এখন নরম--

এবং এই হচ্ছে সময়।

হাত একটু বাড়াতে পারলেই

ঘাট-খরচাটা উঠে আসবে।

এক কোনে ছেঁড়া জামা পরে

শুকনো চোখে

দাঁতে দাঁত দিয়ে

ছেলেটা আমার

পুঁটুলি পাকিয়ে ব'সে।

বোকা ছেলে আমার,

ছি ছি, এই তুই বীরপুরুষ?

শীতের তো সবে শুরু--

এখনই কি কাঁপলে আমাদের চলে?

ফুলগুলো সরিয়ে নাও,

আমার লাগছে।

মালা জমে জমে পাহাড় হয়

ফুল জমতে পাথর।

পাথরটা সরিয়ে নাও,

আমার লাগছে।



ফুলকে দিয়ে

মানুষ বড় বেশি মিথ্যে বলায় বলেই

ফুলের ওপর কোনোদিনই আমার টান নেই।

তার চেয়ে আমার পছন্দ

আগুনের ফুলকি

যা দিয়ে কোনোদিন কারো মুখোশ হয় না।

ঠিক এমনটাই যে হবে,

আমি জানতাম।

ভালোবাসার ফেনাগুলো একদিন উথলে উঠবে

এ আমি জানতাম।

যে-বুকের

যে আধারেই ভরে রাখি না কেন

ভালোবাসাগুলো আমার

আমারই থাকবে।

রাতের পর রাত আমি জেগে থেকে দেখেছি

কতক্ষনে কিভাবে সকাল হয়;

আমার দিনমান গেছে

অন্ধকারের রহস্য ভেদ করতে।

আমি এক দিন , এক মুহূর্তের জন্যেও

থামি নি।

জীবন থেকে রস নিংড়ে নিয়ে

বুকের ঘটে ঘটে আমি ঢেলে রেখেছিলাম

আজ তা উথলে উঠল না।

আমি আর শুধু কথায় তুষ্ট নই;

যেখান থেকে সমস্ত কথা উঠে আসে

যেখানে যায়

কথার সেই উৎসে

নামের সেই পরিনামে,

জল-মাটি-হাওয়ায়

আমি নিজেকে মিশিয়ে দিতে চাই।

কাঁধ বদল করো।

এবার

স্তুপাকার কাঠ আমাকে নিক।

আগুনের একটি রমনীয় ফুলকি

আমাকে ফুলের সমস্ত ব্যথা

ভুলিয়ে দিক॥

Previous Post Next Post