জন্ম ১৯১৮ সালে পাবনা জেলায়। একজন বাংলাদেশী লেখক, ঔপন্যাসিক, গল্পকার ও সম্পাদক। কর্মজীবনে বাংলা একাডেমিতে চাকরিকালিন সময়ে ১৯৬৫ (মতান্তরে ১৯৬৪) সালে সেন্ট্রাল পাবলিক লাইব্রেরীতে শিশু গ্রন্থমেলার আয়োজন করেন। মূলত এটাই ছিল বাংলাদেশের গ্রন্থমেলার সূচনা। গ্রন্থমেলা আয়োজনের নেপথ্যে ছিলেন এই মানুষটি।
বইমেলার শুরু নিয়ে অনেক ধরনের গল্প প্রচলিত আছে। যেমন ১৯৭০ সালে নারায়নগঞ্জের ঘটনা। মাঠের মাঝখানে একটা গরু বাঁধা আর গরুর গায়ে গোটা অক্ষরে লেখা ‘আমি বই পড়ি না’ আর মাঠে কিছু বইয়ের দোকান। উৎসুক জনতা বই কিনতে আসুক বা না আসুক, এই কান্ড দেখতে ঠিকই এসেছিলো এবং বইমেলা জমে উঠেছিলো।
আবার কথিত আছে ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারী মুক্তধারার প্রকাশক চিত্তরঞ্জন সাহা বর্ধমান হাউজ প্রাঙ্গণে বটতলায় এক টুকরো চটের ওপর ৩২টি বই সাজিয়ে বইমেলার গোড়াপত্তন করেন। সেখান থেকে আজকের এই অমর একুশে গ্রন্থমেলা।
সুতরাং বলা চলে বাংলাদেশের বইমেলার বেশ চমকপ্রদ ইতিহাস রয়েছে। বাংলাদেশে কখন আর কিভাবে বইমেলার গোড়াপত্তন হয় একটু জেনে নেওয়া যাক!
তখনো বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের জন্ম হয়নি। ভাষা আন্দোলন প্রচন্ড ভাবে নাড়া দেয় সবকিছুকে। আকাশের কালো মেঘ সরে উঁকি দিচ্ছে স্বাধীন দেশের সোনালী সূর্য। সেই তাপে ১৯৫৫ সালে প্রতিষ্ঠা হয়ে গেলো বাংলা একাডেমি। তারপর দশ বছর পেরিয়ে ১৯৬৫ সাল। বাংলা একাডেমির পরিচালক পদে কথাসাহিত্যিক ও জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সাবেক পরিচালক সরদার জয়েনউদদীন।
জয়েনউদদীন তখন একটি বইমেলা করার চিন্তা করেন। তৎকালীন কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরির নিচতলায় শিশুগ্রন্থমেলা আয়োজন করেন। ১৯৬৫ সালে অনুষ্ঠিত সাত দিন ব্যাপী আয়োজিত এটাই ছিল বাংলাদেশের প্রথম বইমেলা। তারপর ১৯৭০ সালে নারায়ণগঞ্জে।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বইমেলা বসে ১৯৭২ সালে। বিভিন্ন লেখায় ফেব্রুয়ারী এবং ডিসেম্বর সময়কালের উল্লেখ পাওয়া যায়। এখানে অনেকে দ্বিমত পোষণ করেন, অনেকে অনেক ধরনের গল্প বলেন। কেও বলেন রুহুল আমিন নিজামী আবার কেও বলেন চিত্তরঞ্জন সাহা।
তবে অধিক স্বীকৃত এই যে জয়েনউদদীন ১৯৭২ সালে যখন গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক। আগের বইমেলা গুলো তাকে পুরোপুরি তৃপ্ত করতে পারেননি। সেই সময়ে ইউনেস্কো ঐ সময়ে ‘আন্তর্জাতিক গ্রন্থবর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করে। গ্রন্থমেলায় আগ্রহী সরদার জয়েনউদদীন এই আন্তর্জাতিক গ্রন্থবর্ষ উপলক্ষে ১৯৭২ সালে ডিসেম্বর মাসে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে একটি আন্তর্জাতিক গ্রন্থমেলার আয়োজন করেন। সেই থেকেই বাংলা একাডেমিতে বইমেলার সূচনা।
১৯৭২ সালে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলা একাডেমির একুশের অনুষ্ঠানে কোনো বইমেলা হয়নি। তবে ডিসেম্বরে গ্রন্থমেলায় বাংলা একাডেমির দেয়ালের বাইরে স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্সের রুহুল আমিন নিজামী তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রগতি প্রকাশনীর বইয়ের পসরা সাজিয়ে বসেন। তার দেখাদেখি মুক্তধারা প্রকাশনীর চিত্তরঞ্জন সাহা এবং বর্ণমিছিলের তাজুল ইসলামও ওভাবেই তাদের বই নিয়ে বসে যান।
১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমির উদ্যোগে জাতীয় সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেলার উদ্বোধন করেন। সে উপলক্ষে নিজামী, চিত্তবাবু এবং বর্ণমিছিলসহ সাত- আটজন প্রকাশক একাডেমির ভেতরে পূর্ব দিকের দেয়ালঘেঁষে বই সাজিয়ে বসে যান।
প্রকাশকদের এই স্বতঃস্ফূর্ত, স্বতঃপ্রণোদিত সমাগম দেখে ১৯৭৫ সালে বাংলা একাডেমি বর্ধমান হাউস প্রাঙ্গণে চুনের সাদা দাগ দিয়ে প্রকাশকদের জন্য নির্দিষ্ট জায়গা বরাদ্দ করে দেয়। সে বছরই প্রথম নিজস্ব বিক্রয়কেন্দ্রের বাইরে বাংলা একাডেমিও একটি স্টল দেয়। এরপর থেকে বাংলা একাডেমিতে একটি বইমেলা আয়োজনের জন্য বইপ্রেমীদের চাপ বাড়তে থাকে।
তবে, ১৯৭২ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত এই আয়োজনের কোনো নাম ছিল না। ১৯৭৮ সালে একাডেমির মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী বাংলা একাডেমিকে এই বইমেলার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত করেন। ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মেলা আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিয়ে বাংলা একাডেমি বইমেলার নামকরণ করা হয় ‘একুশে গ্রন্থমেলা’। ১৯৮৩ সালে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মনজুরে মওলা বাংলা একাডেমিতে প্রথম ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’–এর আয়োজন করেন।
একটা সময় ছিল মেলা বাংলা একাডেমির ভেতরেই হতো। একদম শুরুতে প্রকাশক ছিলেন কম। চুন দিয়ে মাটিতে ও দেয়ালে বিভাজক তৈরি করে প্রকাশকদের স্থান আলাদা করে দেয়া হতো। এখন অনেক প্রকাশকের সমাগম হয় একুশে বইমেলায়। তাছাড়া প্রচুর লোকসমাগমের কারণে বাংলা একাডেমিতে স্থানের সংকুলান হচ্ছিল না। এসব দিক বিবেচনা করে ২০১৪ সালে বাংলা একাডেমির অদূরে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে মেলাকে স্থানান্তরিত করা হয়। এর ফলে মেলা বেশ সম্প্রসারিত হয়। বর্তমানে ফেব্রুয়ারি মাসে অনেক জেলা শহরেও মেলা আয়োজনের খবর পাওয়া যায়।
ভাবলে খুব ভালো লাগে, একদিন বিছিন্ন ভাবে যে মেলা শুরু হয়েছিল, সেই মেলা আজ কয়েক স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা, শত শত বর্ণিল স্টল, দেশ-বিদেশের হাজারো মানুষের ঢল এবং দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষ্ঠান হিসেবে কালের সাক্ষী বহন করে চলেছে।