ভাসানীর ভারত প্রবাসঃ- পাকিস্তানি শাসক চক্রের ষড়যন্ত্রের ইতিহাস


কৃষক শ্রমিক নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী রাজনৈতিক অঙ্গনের এক মহারথী। বিংশতাব্দীর ব্রিটিশ ভারত এবং তৎকালীন পাকিস্তানের রাজনৈতিক গতিপথের অন্যতম নীতিনির্ধারক। কিন্তু ১৯৫৫ সালে এই মানুষটি চার মাস নির্বাসনে ছিলেন। পাকিস্তান সরকার তাঁকে দেশে প্রবেশ করতে দেয়নি। মওলানা ভাসানীর পরবাসের সেই সময়টি পাকিস্তানের ইতিহাসে ষড়যন্ত্রের এক মহাক্ষণ। গণতন্ত্রকে ভেঙে সামরিক তন্ত্র প্রতিষ্ঠার পায়তারা চলতে থাকে পাকিস্তানে। পূর্ব বাংলার স্বার্থের বিরুদ্ধে চলে এক মহা চক্রান্ত। ভানাসীর প্রবাসের সেই সময়টুকু রাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সৈয়দ আবুল মকসুদ ভাসানীর ভারত প্রবাস বইয়ে সেইসব ঘটনাপ্রবাহ তুলে এনেছেন।


বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে যোগ দিতে ভাসানীকে যেতে হয় লন্ডন। বেশ কিছুদিন ইউরোপ ঘুরে যখন দেশে ফিরবেন তখন ঘটে মূল বিপত্তি। পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করেন, ভাসানী পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্য মহা বিপদজনক। দেশে ফিরলে গ্রেপ্তার করা হয় যেন। দলীয় নেতা কর্মীরা সংবাদ পাঠালেন। তাও দেশে ফিরতে মরিয়া ভাসানী, আার কথা অনেক কাজ বাকি। নিজের গ্রামে ফিরতে চান ভাসানী। কিন্তু অনেক অালোচনার পর লন্ডন থেকে পূর্ব পাকিস্তানে ফেরার পথে দীর্ঘ পাঁচ মাস ভারতে অবস্থান করেন মওলানা ভাসানী। কিন্তু এই সময়ে চুপ করে বসে ছিলেন না তিনি। কাজ করেছেন রাজনীতির জন্য। পূর্ব বাংলার অাসাম সহ বহু স্থানে ঘুরে শিক্ষা ব্যবস্থা দেখেছেন। এই দীর্ঘ সময়ে তার কাজ এবং মুভমেন্ট গুলো উঠে এসেছে বইয়ের পাতায়।


মওলানা ভাসানী তাঁর জীবন আদর্শে ছিলেন অটুট। সাদামাটা জীবন যাপন আর পরিমিত ছিলেন সবকিছুতে। ভাসানীর ভারত প্রবাস বইয়ে প্রবাস জীবনের সেই সাদামাটা জীবন উঠে এসেছে সৈয়দ অাবুল মকসুদের সুনিপুণ হাতে। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী যখন কলকাতা পৌঁছালেন তখন পশ্চিমবঙ্গ সরকার থেকে তার থাকার সব ব্যবস্থা করে দিলেন। সন্ধায় তাকে নিয়ে যাওয়া হল এক বাড়িতে। এত জাঁকজমকপূর্ণ দেখে সকল হলে কর্মচারীদের ডেকে বলেন বাড়ির মালিক কোথায়? বাড়ির কর্মচারীরা জানালো যে, এ এক জমিদার বাড়ি। এখানে কেও থাকে না। আপনার জন্য এখানে ব্যবস্থা করা হয়েছে। সারাজীবন জমিদারি প্রথার বিরুদ্ধে থেকে তিনি সেই সুখ ভোগ করবেন তেমন তিনি ছিলেন না। সে-দিনই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসলেন। গিয়ে উঠলেন সস্তার এক হোটেলে। হোটেলের খরচ বাঁচাতে কিছুদিন তিনি আসামে তার মুরিদদের বাড়িতেও থেকেছেন। সারাজীবন সাদামাটা জীবনে অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। জমিদার বাড়ির সুখ বিসর্জন দিয়ে সস্তা হোটেল আর আসামে কৃষকদের সাথে বসবাস করে তার প্রবাস জীবন শুরু হয়। তারপর কেটে যায় দীর্ঘ চার মাস।


কি হয়েছিলো ভাসানীর প্রবাস জীবনে?


ঘটনার ব্যাখ্যা না করে চলুন কয়েকটি মূল বিষয় উল্লেখ করা যাক। যেন পাঠকের সুবিধা হয় ঠিক কোন কোন বিষয় বইয়ে উঠে এসেছে;


* কলকাতা থেকে আসাম

* আদমজীতে দাঙ্গা 

* পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র

* ভাসানীর ২৪ দফা

* যুক্তফ্রন্টের ঐক্যের আহ্বান 

* অবাঙালী ব্যবসায়ী সম্পর্কে মতামত 

* ভাসানী সোহরাওয়ার্দী রুদ্ধদ্বার বৈঠক

* দলীয় নেতা কর্মীদের সাথে বৈঠক 

* প্রত্যাবর্তন


উল্লেখিত প্রতিটি বিষয় নিয়ে বইয়ে আলোচনা করা হয়েছে। মূলত ভাসানীর ভারতে অবস্থান কালে যে সমস্ত ঘটনা ঘটেছিলো, যার সাথে মওলানা সাহেব যুক্ত ঐ সবকিছুই বইতে উল্লেখ রয়েছে। তৎকালীন রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে খুব দারুণ কিছু ঘটনাও বইতে রয়েছে।


বইটিকে পক্ষপাত দুষ্ট না হলেও তুষ্ট বলা যায়। মানে বিশেষ কোন ব্যক্তিকে নিয়ে বই রচনা হলে সেই ব্যক্তি দিকটিকে প্রস্ফুটিত করে তোলা হয়। এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। মানে ঠিক সব দিক থেকে ঘটনা বিবেচিত না হয়ে মওলানা ভাসানীর দিক থেকে বইয়ের বর্ণনা উঠে এসেছে। যেহেতু বইয়ের নাম ওনাকে নিয়ে, ওনার কাহিনী নিয়ে এগিয়েছে বইয়ের লেখা। সুতরাং এটা স্বাভাবিক বইয়ের লেখাও ওনার ভাবধারা থেকে লেখা হবে। তবে ভাসানীর কর্মকাণ্ড, ওনার ভাবধারা, ওনার চিন্তা চেতনা, ওনার সংগ্রামী জীবনধারা সম্পর্কে সম্মুখ ধারণা নেওয়ার জন্য খুব ভালো একটা বই। ঝরঝরে লেখা, সুন্দর শব্দের ব্যবহার সব ধরনের পাঠকের পড়ার উপযোগী ভাসানীর ভারত প্রবাস বইটি। আর শ্রদ্ধেয় আবুল মকসুদ সাহেব ভাসানী নিয়ে বেশ লেখালেখিও করেছেন। সবমিলিয়ে মন্দ হবে না।


সৈয়দ আবুল মকসুদ ভাসানী সম্পর্কিত বেশ কয়েকটি বই লিখলেও সেখানে প্রবাস জীবনের কিছু উল্লেখ নেই। অনেকে মওলানা ভাসানী নিয়ে লিখেছেন কিন্তু প্রবাস জীবনের ঐ পাঁচ মাস যেন সব কিছু থেকে অাড়ালে পড়ে গেছে। তাই যারা ঐ সময়ের ঘটনাপ্রবাহ জানতে ইচ্ছুক তাদের জন্য ভাসানীর প্রবাস জীবনের পূর্ণাঙ্গ প্যাকেজ সৈয়দ আবুল মকসুদের লেখা বই "ভাসানীর ভারত প্রবাস"।


বইঃ ভাসানীর ভারত প্রবাস

লেখকঃ সৈয়দ আবুল মকসুদ

প্রকাশনীঃ পাঠক সমাবেশ

মূল্যঃ দুইশত পঞ্চাশ টাকা

Previous Post Next Post