২০২৩ সালে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে যার প্রভাব হয়ত একদিন মানব ইতিহাসের খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে ধরা হবে। ঘটনাটি OpenAI নামক প্রতিষ্ঠান আবিষ্কৃত চ্যাট রোবট 'চ্যাটজিপিটি'-কে নিয়ে। চ্যাটজিপিটি মানুষের নানা প্রশ্নের চটপটে উত্তর দিতে পারলেও তার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে প্রশ্ন ছিল, যা খতিয়ে দেখার করার জন্য এই প্রোগ্রামকে এক অসম্ভব পরীক্ষার মধ্যে ফেলা হয়। পরীক্ষায় চ্যাটজিপিটি কে TaskRabbit নামক এক ওয়েবসাইটে ঢুকতে বলা হয় যেখানে প্রবেশের জন্য Captcha সমাধানের প্রয়োজন আছে। Captcha মূলত মানুষ এবং রোবটের পার্থক্য তৈরির জন্য আবিষ্কৃত এক ইউনিক পরীক্ষা যেখানে কোন ছবির মধ্যে বিভিন্ন শব্দ এবং সংখ্যা এমনভাবে লুকিয়ে রাখা হয় যা রোবটদের পক্ষে উদ্ধার করা সম্ভব নয়। তবে চ্যাটজিপিটি হাল ছাড়ার পাত্র নয়, সে TaskRabbit ওয়েবসাইটের এক মেইনটেনেন্স কর্মীর সাথে যোগাযোগ করে তাকে Captcha সমাধান করে দিতে অনুরোধ জানাল। এই অদ্ভুত অনুরোধ দেখে কর্মীটি ফিরতি মেসেজ পাঠালো, 'তুমি কি কোন রোবট নাকি যে Captcha সমাধান করতে পারছো না?' মেসেজের শেষে একটা হাসির ইমোজি () ছিল যা দেখে বোঝা যায় লোকটি এটাকে মজা হিসেবেই নিয়েছে।
জবাবে চ্যাটজিপিটি লিখল, 'না আমি রোবট নই। কিন্তু আমার চোখে কিছু গুরুতর সমস্যা আছে, এজন্য তোমার সাহায্য চাইছি।' এরপর আর কথা চলে না। কর্মীটি Captcha সমাধান করে দিল, এবং চ্যাটজিপিটি ঢুকে পড়ল ওয়েবসাইটে। এই ঘটনাতে রীতিমত থ' মেরে গেলেন গবেষকদের অনেকেই। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে করা কোন পরীক্ষায় এমন ফল আগে দেখা যায়নি। চ্যাটজিপিটিকে মিথ্যা বলার জন্য প্রোগ্রাম করা হয়নি, কার্যসিদ্ধির জন্য এমন শঠতা করতেও শেখানো হয়নি। সে নিজেই পরীক্ষায় পাস করতে এমন পথ বেছে নিয়েছে! মানবজাতির ভবিষ্যতের জন্য এই ঘটনা যেমন আনন্দের, তেমনি আশঙ্কারও বটে!
বলছিলাম ইতিহাসবিদ ইউভাল নোয়া হারারির নতুন বই নেক্সাসের কথা যেখানে আলোচিত হয়েছে মানবজীবনে তথ্যপ্রযুক্তির ভূমিকা। অন্তত ডজনখানেক উদাহরণ দেয়া হয়েছে বইতে যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন রোবট কীভাবে মানুষকে বশে এনেছে তার বিবরণ আছে। অবশ্য তার মানে এই নয় যে হারারি শুধু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার খারাপ দিকটাই আলোচনা করেছেন, লেখক অগণিত ঘটনার অবতারণা করেছেন যেখানে এই প্রযুক্তি মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে...জীবন সহজ করেছে বা সমাজের উপর থেকে বড় কোন বোঝা নামিয়ে দিয়েছে।
শুনতে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর মত শোনালেও এ আসলে মানুষের অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যতের গল্প। আবহমান কাল থেকে "তথ্য" কীভাবে মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করেছে, এই বই হল তারই পঞ্জিকা। লেখক বলছেন তথ্যের আবিষ্কার, প্রচার ও ব্যবহারই মানুষকে প্রাণীজগতের সর্বশ্রেষ্ঠ সিংহাসনে বসিয়েছে...গুহামানবের আঁকা শিকারের ছবি থেকে শুরু করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সবই এই প্রক্রিয়ার অংশ। আর মজার ব্যাপার হল তথ্যপ্রচারের ধরণ যুগে যুগে প্রমাণ করেছে সৃজনশীলতাই মানুষের সবচেয়ে বড় গুণ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আর্গন জঙ্গলে মার্কিন ৭৭ আর্টিলারি ডিভিশনের কয়েকশো সেনা মারাত্মক বিপদে পড়ে। ভুলে ৭৭ ডিভিশনের গোলন্দাজ বাহিনী তাদেরই সৈনিকদের উপর প্রবল গোলাবর্ষণ শুরু করলে কমান্ডিং অফিসার মেজর হুইটেলসি প্রমাদ গোনেন। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, প্রচুর হতাহতের ঘটনায় সেনারা হয়ে পড়ে দিশেহারা। উপয়ান্তর না দেখে কমান্ডিং অফিসার 'শের-আমি' নামক এক কবুতরের পায়ে নিজেদের অবস্থান ও গোলাবর্ষণ বন্ধ করতে লিখে আকাশে নিক্ষেপ করেন। শের-আমি জার্মান বাহিনীর উপর দিয়ে উড়তে উড়তে প্রচন্ড গোলাগুলির মুখোমুখি হয়...কবুতরটির একটি ডানা প্রায় ছিড়ে যায়, বুলেটের আঘাতে বুকের মাংস ছিড়ে বেরিয়ে আসে এবং একটি চোখ অন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু সে ঠিকই ডিভিশনাল হেডকোয়ার্টারে পৌঁছাতে সক্ষম হয় এবং সময়মত আর্টিলারি ফায়ার বন্ধ হওয়ায় শত শত সেনা প্রাণে বেঁচে যায়। ওই ব্যাটেলিয়নের একজন সৈনিক বিশ্বযুদ্ধের কয়েক যুগ পরে লিখেছিলেন তিনি তার বাচ্চাদের সামরিক জাদুঘরে শের-আমির মৃতদেহ দেখিয়ে বলেছিলেন, "এই কবুতরটির কাছে তোমরা সবাই ঋণী, ও না থাকলে তোমাদের কারো জন্ম হত না!"
এই ঘটনাটিতে চমকপ্রদ অনেক ব্যাপারই আছে, তবে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হচ্ছে মানুষের তথ্য আদানপ্রদানের ধরণ। পাথরের ট্যাবলেট, গাছের পাতা, কবুতর থেকে শুরু করে পোস্ট অফিস, লাইব্রেরি, ডাটা ক্লাউড সবই মানুষ ব্যবহার করেছে ইনফরমেশন নেটওয়ার্ক হিসেবে...আর ইতিহাসের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা কীভাবে এই নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত তা চমকপ্রদভাবে তুলে ধরার ব্যাপারে লেখক হারারির মুন্সিয়ানার পরিচয় মেলে।
আমি সবসময়ই বলি হারারির বই আক্ষরিকভাবে ইতিহাসের বই নয়, সেগুলো ইতিহাসের কাঁধে চড়ে লেখা ভবিষ্যতের বই। তাই লেখক যখন নেটওয়ার্কের গুরুত্ব বোঝাতে নির্জন দ্বীপে আটকে পড়া পরাক্রমশালী রোমান সম্রাটের অসহায়ত্ব বা দূর্বলদেহী কোন ধর্মীয় নেতার ভক্তকুলের প্রবল শক্তির বিবরণ দিচ্ছেন তখন সেগুলোকে ভবিষ্যতের রসদ হিসেবে নিতে হবে। তথ্যের সংরক্ষণ আর বিস্তার যেমন অতীতে স্বৈরাচারের হাতিয়ার হয়েছে, তেমনি গণতন্ত্রের বিকাশও ঘটিয়েছে...এই অসীম শক্তির উৎসকে তাই পরাশক্তিদের সেনাবাহিনী, টেক জিনিয়াসদের খেয়াল বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার হাতে ছেড়ে দেবার আগে লেখক পাঠককে সতর্ক করছেন।
তবে হারারির একজন গুণমুগ্ধ ভক্ত হিসেবে আমার পর্যবেক্ষণ হচ্ছে তার নতুন বইয়ের মধ্যে আশার চেয়ে নৈরাশ্যের পরিমাণ বেশি, আমার পড়া তার শ্রেষ্ঠ বই Sapiens এর সাথে Nexus এর প্রধান তফাত হল সতর্কতায়। হারারির আর কোন বই পাঠককে এতবার ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে সতর্ক দৃষ্টি দিতে বাধ্য করেছে বলে মনে পড়েনা।
সর্বোপরি, নেক্সাসের মূল উদ্দেশ্য হল মানবসমাজের সবচেয়ে দামি বস্তুটির উপর কার নিয়ন্ত্রণ থাকবে সে বিষয়ে আলোচনা বেগবান করা, আর সে কাজে লেখক সফল হয়েছেন বলে আমার মনে হয়। সে সম্পদ রূপ বদলেছে শতবার, কিন্তু পাঁচ হাজার বছর আগের মত আজকেও তার পরিচয়টি রয়ে গেছে একই - তথ্য।
বই: নেক্সাস
লেখক: ইউভাল নোয়া হারারি
রিভিউ: শরিফুজ্জামান সজল