অলীক মানুষ: লৌকিক-অলৌকিক বিষাদের অখণ্ড অবয়ব

                                      


প্রাণিকূলের মধ্যে সম্ভবত মানুষের স্বভাবই সবচেয়ে বেশি বৈচিত্র্যময়। তাই পৃথক বৈশিষ্ট্যধারী কোনো মানুষ বা বস্তুকে দূর থেকে দেখে মানুষ সম্ভাবনার মোড়কে নানান গল্প রচনা করে। হোক সেই বৈশিষ্ট্য ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অথবা বিশাল। সেই মানুষ বা বস্তুকে নিয়ে অলীক আর অসম্ভব ভাবনার বুদবুদ তার রুদ্ধ করোটিতে ঘুরপাক খায়। সেই ঘূর্ণিতে পাক খেতে খেতে কোনো কোনো মানুষ যেমন নিজেকে খুব বিচক্ষণ ভাবে তেমনি অন্যের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দিহান হয়, তাকে কটাক্ষ করে। এর উল্টোটাও ঘটে। কোনো কোনো দুর্বলচিত্তের মানুষ পূজারী হয়ে মানুষটিকে দেবতার আসনে বসায়; ভাবে, এই দেবতার উছিলাতেই তার সকল মুশকিল আশান হবে। 


তেমনই অলৌকিক ক্ষমতাধর একজন মানুষ সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের উপন্যাস ‘অলীক মানুষ’র শফিউজ্জামানের পিতা বদিউজ্জমান ওরফে বদু পীর, যার পুরো নাম সৈয়দ আবুল কাশেম মুহম্মদ বদি-উজ-জামান আল-হুসায়নি আল-খুরাসানি। বদু পীর পূর্ববাংলার ফরাজি আন্দোলনের প্রবক্তা হাজি শরিয়তুল্লাহর শিষ্য, নিজেই এখন ফরাজি ধর্মগুরু। তিনি কালে কালে মানব থেকে অলৌকিক মানব হয়ে যান আর একজন রক্তমাংসের মানুষকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা মিথ কালেকালে সাধারণ মানুষের কাছে চূড়ান্ত সত্যি হয়ে ওঠে।


শাদা আলখেল্লা আর শাদা পাগড়ি-পরা বদিউজ্জামানকে দেখে তাই ঐশী নিদর্শন অনুসন্ধানে আকুল মোলাহাটের মানুষের মনে হয়, ‘ঐ মানুষ দুনিয়ার নন।’ আবার বদিউজ্জামানের স্ত্রী সাইদার পেটে নাড়ি কচলানো ব্যথা বুজুর্গ স্বামীর দোওয়া পড়ে ফুঁ দেওয়া পানি খেয়ে সেরে যায়। সাইদা জানে, তার মতো অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী মানুষের সঙ্গে দেখা করতে নিশুতিরাতে দলিজঘরে আসমান থেকে জিনেরা নেমে আসে তাই জানালা দিয়ে শাদা রোশনি ঠিকরে পড়ে।


পীরের প্রতি ভক্তি দেখাতে দূরদূরান্ত থেকে ভক্তরা ছুটে ছুটে আসে। আর তাই দলিজঘরের বারান্দা শস্য, শাক-সবজি, মাছ, মোরগমুরগি, খাসি ইত্যাদিতে ভরপুর হয়ে থাকে, পীর বাড়ির বাচ্চা থেকে শুরু করে পরিবারের সকল সদস্য মানুষের সমীহের জায়গায় থাকেন। তবু সামান্য মতভেদ, ব্যক্তিত্ত্বের দ্বন্দ্ব বা অজানা কোনো কারণে বদু পীর স্থান পরিবর্তন করে নতুন নতুন জায়গায় ছুটে বেড়ান। তাই ‘‘বদিউজ্জামানের সংসার সবসময় তৈরি থাকত, কখন হুকুম জারি হবে, উঠে পড়ো, গুটিয়ে নাও।’' গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরে বেড়িয়েছেন বদিউজ্জামান, কাঁটালিয়া, পোখরা, বিনুটি, গোবিন্দপুর, নবাবগঞ্জ, কুতুবপুর, খয়রাডাঙা থেকে মোলাহাট যার প্রস্থানে ভক্তরা বারবার চোখের পানি ফেলেছে। 


বদিউজ্জামানও চোখের পানি মুছতে মুছতে ভক্তকূলকে আল্লাহর কাছে রেখে গেছেন, মোহররমের তাজিয়া জুলুসকে গ্রামে ঢুকতে দিতে বারণ করেছেন, পীরের থানে মানত দিতে নিষেধ করেছেন, নামাজ না পড়লে জরিমানা করতে বলেছেন, তাদের ধর্মের পথে থাকতে বলেছেন। কিন্তু তাদের ‘‘হুজুর চলে গেলে সেসব অবশ্য কিছুই করা হত না। কারণ তাতে দলাদলি ও হাঙ্গামার আশংকা ছিল। মেয়েরা আবার বেপর্দা হয়ে মাঠে মরদ-ব্যাটাদের নাশতা দিয়ে আসত। শাদি লাগলে ঢোল বাজিয়ে গীত গাইত আগের মতোই। নাচত এবং সঙ দিত। পাশের গাঁয়ের হানাফি মজহাবের জোয়ানরা মোহররমের মিছিল এনে খবর পাঠাত ঢুকবে নাকি এবং অনুমতিও পেত। তবে প্রধান ফরাজিরা দেখে না-দেখার শুনেও না-শোনার ভান করে আড়ালে গিয়ে বসত।’’ সত্যি কখনো কখনো মানবচরিত্র এই ধরণীর চেয়েও রহস্যময়।


এই উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র বদিউজ্জামানের পুত্র শফিউজ্জামান। শফিউজ্জামান ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত, ধর্মদ্রোহী ও আত্মদ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত একজন মানুষ। উপন্যাসের পাঠ যত এগোয় পিতার দৃষ্টিবঙ্গির সঙ্গে শফিউজ্জামানের বিস্তর ফারাক চোখে পড়তে থাকে। একসময় শফিউজ্জামান সদরে দায়রা আদালতে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামী হয়ে যায় আর তার স্মৃতিতে উঠে আসে শাদা জিন-কালো জিন, প্রাচীন মোজেজা উলুকাশের শোঁ শোঁ শনশন আওয়াজ, ব্যানাবনে ঢ্যামনা সাপের ঢুকে পড়া, নরম কুয়াশায় মুছে যাওয়া সূর্য, মৌলাহাটের দক্ষিণপ্রান্তে শাহি মসজিদের নিচে প্রকাণ্ড বটতলায় একলা হয়ে পড়া, রূপমতী বিলের পদ্ম, প্রগলভ আয়মনি, স্বাধীনতাময় পরাবাস্তবতার দূরতম প্রান্তে দাঁড়ানো রুকু, কুষ্ঠরোগী আবদুলের বউ ইকরা, সহপাঠী ববিউদ্দিনের কাছ থেকে পাওয়া নিষিদ্ধ পাঠ, পুরুষের জীবনের নিষিদ্ধ নির্বাসিত কষ্টকাল, জীবনের প্রথম পাপক্রীড়া, মেহরুর বউ শ্রমজীবী গ্রামীণ নারী আসমা, মৃতদের শহর লালবাগ, পান্না পেশোয়ারি, অস্থিরচিত্তের বিড্ডু, স্বদেশীবাবু যামিনী, বড়োগাজি, নাস্তিক বারুমিয়া। 


বারুমিয়া ওরফে দেওয়ান আবদুল বারি চৌধুরি শফির জ্ঞান-দর্শনচিন্তায় বিস্তর প্রভাব রাখেন। প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে নিয়ে গিয়ে তিনি শফিকে গোপন কথা বলতে চান কারণ, ‘প্রকৃতিই মানুষকে প্রকৃত গোপনীয়তা দিতে পারে।’’ এই মুক্তমনা মানুষটির অনুপ্রেরণাতে নিজের গ্রাম থেকে দু-ক্রোশ দূরে হরিণমারা গ্রামের ইংরেজি হাইস্কুলে শফির নতুন শিক্ষাজীবন শুরু হয়। আর লৌকিক-অলৌকিক ভাবনা ও বিশ্বাসের চিরায়ত দ্বন্দ্বের আবহে শফি বড় হতে থাকে। সেই বেড়ে ওঠার কাল আশ্চর্য বৈচিত্র্যময়।


পীর বদিউজ্জামানের স্ত্রী সাইদা বাংলা পুঁথি পড়েন, ছেলে শফিউজ্জামান শোনে আশ্চর্য সব কাহিনী, ‘‘বাদশাহ নমরুদ খাটিয়ার শীর্ষে মাংসখণ্ড ঝুলিয়ে তিনটে শকুনকে লোভ দেখিয়ে আসমানে উঠেছেন, হাতে তীরধনুক, খোদার বুকে তীর মারবেন। আর খোদা মুচকি হেসে ফেরেশতাকে বলছেন, বেচারা নমরুদকে খুশি করো। ওর ছুঁড়ে মারা তীরের ডগায় রক্ত মাখিয়ে ফেরত পাঠাও। তখন ফেরেশতারা রক্ত চেয়ে বেড়াচ্ছেন হন্যে হয়ে। শেষে মাছ দিল রক্ত। আর খোদা বললেন হে মাছ এরপর থেকে মরা অবস্থাতেও তুমি হারাম বলে গণ্য হবে না।’’




এমনই অনেক অলৌকিক-লৌকিক মায়া, মোজেজার গল্প আছে এই উপন্যাসে। ব্রাক্ষ্মণ আর পীরের অলৌকিক লড়াইয়ের গল্প, বিবি আয়েশার কানের দুল হারানোর বিপদ, হিন্দু-মুসলমানের বাদশাহি সড়কের গল্প, খোঁড়াপিরের থানের গল্প, বাড়ির পেছনের শ্যাঁওড়াগাছে উলঙ্গ ইকরার চুল এলিয়ে উঠে বসার গল্প, বালক পয়গম্বরের সিনা-চাথ বা বক্ষবিদারণ, মহুলার নদীতীরে পীর সাহেবের হেঁটে যাওয়া পথ শাদা আর ধূসর মাটির বাঁধের ক্রমশ পাথরে পরিণত হওয়া ইত্যাদি।


উপন্যাসের কিছু গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র শফির মানসিক প্রতিবন্ধী ভাই মনিরুজ্জামান, সিতারা, স্বাধীনবালা, রত্নময়ী আর রুকু। রুকু আর শফির বেদনামথিত অনুভব মনকে বারবার ক্ষতবিক্ষত করে। সেই সঙ্গে রুকুর দুর্দশা দেখে বদিউজ্জামানের প্রতি অদৃশ্য এক ক্ষোভ জ্বলে ওঠে। ছটছটে প্রজাপতি রুকুর জীবন হঠাৎ করে বদলে যায়, ‘‘চোখ বুজে দাঁতে দাঁত চেপে রুকু তার অবশ শরীর রেখে পালিয়ে যায়-পালাতেই থাকে-দূরে-বহুদূরে। কিন্তু কোথায় যাবে? কার কাছেই বা তার এই মানসিক সফর?’’ আবার কিশোর শফির মানসিক সফরে রুকুর অজান্তে থাকে রুকু। 


রুকুর বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর থেকে শফি অভিমানের এক জটিল আবর্তে ঘুরপাক খেতে থাকে। শফির ভেতরে ঘটতে থাকে রূপান্তর। অদ্ভুত খেয়ালে শফি একসময় হয়ে ওঠে বোহেমিয়ান। নাস্তিকও। শফি ধর্মকে ঘৃণা করে। সে বিশ্বাস করে, "ধর্মই মানুষের জীবনে যাবতীয় কষ্ট আর গ্লানির মূলে। ধর্ম মানুষকে হিন্দু বা মুসলমান করে। ধর্ম মানুষের স্বাভাবিক চেতনা আর বুদ্ধিকে ঘোলাটে করে। তার চোখে পরিয়ে দেয় ঘানির বলদের মতো ঠুলি।" উপন্যাসের বিভিন্ন জায়গায় ধর্ম নিয়ে এমন সব দুঃসাহসী উচ্চারণ আছে যা পড়ে চমকে উঠতে হয়। সেই কত বছর আগেও লেখক সাহসিকতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন ধর্মের প্রতি মানুষের অবিশ্বাস, অন্তর্দাহকে।


ধর্মভীরু বদিউজ্জামানও নানান অন্তর্দ্বন্দ্বে ভোগেন। পীরতন্ত্রের বিরুদ্ধে জেহাদ করতে করতে তিনি নিজেই ক্রমশ পীর হয়ে ওঠেন। নিরুদ্দিষ্ট পুত্রের জন্য উদ্বিগ্ন বদিউজ্জামান তার প্রতি পদক্ষেপ ও কাজে মানুষের মোজেজা খোঁজাকে নির্বুদ্ধিতা মনে করে রুষ্ট হন। শাদা জিন-কালো জিনকে দেখতে পারার মোজেজার অধিকারী হয়েও বশীভূত হন জৈব সন্তোষের কাছে। আবার শরিয়তের টানে তার ভাই সুফী ফরিদুজ্জামান নিরুদ্দিষ্ট হয়েছে, তিনি কি ভাইয়ের মতো সর্বত্যাগী সাধকপুরুষ হতে পেরেছেন-এই ভাবনাতে আত্মপীড়নে ভোগেন। মাঝেমাঝে তার মনের ভেতর উটকো সব কথা গাছ থেকে পাতার মতো খসে পড়ে, মনের ভেতরে চলতে থাকে গুঞ্জণ, হুঁশিয়ার, হুঁশিয়ার…। 


বাস্তব-পরাবাস্তবতার দ্বন্দ্ব, সাধারণের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে গিয়ে মানুষের অলীক মানুষ হয়ে ওঠার এই গল্প পড়তে পড়তে বারবার শিহরিত হয়েছি। শফি চরিত্রটির নির্মাণ দেখে হয়েছি মুগ্ধ।

  

পিতার ভাবনার বিপ্রতীপ কোণে শফি অবস্থান করে। শরীরের চেয়ে মনের বয়স বেড়ে যাওয়া শফি নিজের ভেতরে কালোরঙের ঘোড়ার পিঠে চেপে আমৃত্যু ছুটতে চাওয়ার বাসনা ধারণ করতে করতে একসময় স্বদেশী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে, ধর্মবিদ্বেষী আর হত্যাকারী হয়ে ওঠে। 


‘অলীক মানুষ’ এর কাহিনী এগিয়েছে কিছুটা বিক্ষিপ্তভাবে। কখনো শফির অতীতমুখীতায়, কখনো শফি বা বদিউজ্জামানের স্বগোতক্তিতে, কখনো বা নামপুরুষে শফি বা বদিউজ্জামানকে নিয়ে ঘটনা বিস্তার লাভ করেছে। রাঢ় বাংলার মুসলমান আর ব্রাহ্মসমাজ, সামাজিক দ্বন্দ্ব, স্বদেশী আন্দোলনসহ বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা মূল কাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে সময়কে ধরে রেখেছে। উপন্যাসে পিতা-পুত্রকে ঘিরে থাকা বিভিন্ন চরিত্রের বিস্তার ঘটেছে আর তাদের ঘিরে ঘটনাক্রমে নানান দ্বন্দ্বসংঘাত এসেছে। সেই সঙ্গে অসংখ্য রহস্যময়তা নিয়ে উপন্যাস এগিয়ে গেছে অভিনব পরিণতির দিকে। 


এই উপন্যাস সম্পর্কে লেখক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ বলেছেন, ‘অলীক মানুষ’ বলতে আমি বুঝিয়েছি ‘মিথিক্যাল ম্যান।’ রক্তমাংসের মানুষকে কেন্দ্র করে যে মিথ গড়ে ওঠে-সেই মিথই একসময় মানুষের প্রকৃত বাস্তব সত্তাকে নিজের কাছে অস্পষ্ট এবং অর্থহীন করে তোলে। ব্যক্তিজীবনের এই ট্র্যাজেডি অলীক মানুষের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়।


প্রায় তিনশ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসের বিভিন্ন অধ্যায়ের শুরুতে বা মাঝখানে লেখক বিভিন্ন ইংরেজি উদ্ধৃতি, শায়েরি বা কবিতার অংশ ব্যবহার করেছেন। এছাড়া প্রচুর বিদেশি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে এই উপন্যাসে। বেশিরভাগ শব্দ প্রচলিত হলেও জ্ঞানের সীমাবদ্ধতায় বেশ কিছু অপ্রচলিত শব্দের অর্থ বুঝতে সমস্যা হয়েছে। কোনো কোনো বাক্য দ্বিতীয়বারও পড়তে হয়েছে। এছাড়া লেখকের বহুরৈখিক বর্ণনাশৈলীর কারণে পাঠে মনোযোগী থাকতে হয়েছে সবসময়। সেই মনোযোগের অখণ্ডতায় কখনো কখনো আরবদেশের নারী নুসাইবার মতো বদু পীরের স্ত্রী সাইদার ছোট ছোট বিদ্রোহের ঘটনা সামনে এসে পাঠক মন সচকিত করে তুলেছে। কখনো বা তড়িৎপ্রবাহের মতো কচি এবং তার দাদিমার কথোপকথন এসে কাহিনীকে আকর্ষণীয় করেছে আর সেই অমোঘ আকর্ষণে উপন্যাসের একেবারে শেষ পৃষ্ঠাতে পৌঁছে গেছি।



রিভিউ

সাদিয়া সুলতানা 

লেখক


Previous Post Next Post