বই: আরণ্যক ছবিঃ ইন্টারনেট |
দু চোখ বন্ধ করে অরণ্য, পাহাড়, নদী, জ্যোছনা দেখতে চাইলে খুলে বসুন বিভূতিভূষণের আরণ্যক। দু'পাতা পড়ুন, চোখ বন্ধ করে কল্পনাশক্তি জাগ্রত করুন, মনে হবে আপনি অরণ্যের পথে প্রান্তরে ঘুড়ে বেড়াচ্ছেন। ঘুরতে ঘুরতে আপনার মন ভারাক্রান্ত হবে, কারণ সময়ের সাথে বন ধ্বংস হয়ে নগর গড়ে উঠছে। অরণ্য, জ্যোছনা হারিয়ে যাচ্ছে। আরণ্যক আসলে কিসের গল্প বলে? অরণ্যের নাকি ধ্বংসের?
ব্রিটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশে আসার আগ পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশে যে জীবনযাপন ছিলো তা অরণ্য, নদী, পাহাড় আর অদৃশ্য নানান সত্তাকে ঘিরে। এককথায় বলতে গেলে আরন্যক প্রাচীনপন্থি জীবন। যে জীবনের চাওয়া পাওয়া অল্পই ছিলো। জাগতিক কামনা-বাসনা, লোভ, সম্পদের চাহিদা, যুদ্ধের দিকে মানুষের ঝোঁক তেমন ছিল না। মানুষ দু-মুঠো খেয়ে, বনেবাদাড়ে ঘুরে, অদৃশ্য ভয়ের নানান দেবতাদের আরতি চড়িয়ে, নানা কুসংস্কার মেনে, চাঁদের বুক চিরে হেঁটে বেড়াত ফরসা আলোকিত বনে।
কিন্তু ব্রিটিশরা এলো, তাদের সম্পদ-লোভ-খাজনার চাহিদা বাড়লো। বনের পর বন উজাড় হতে থাকল ধীরে ধীরে, সরু রাস্তাগুলো প্রশস্ত হয়ে ইটের পথ হলো, মাইলের পর মাইল বসতি হলো মানুষের। নদীর পাশ ছেড়ে মানুষ উঠে এলো বনের মাঝে, পাহাড়ে। অনুর্বর জমিতে, গাছের ঝোপ কেটে তৈরি হলো ফসলি জমি। জনসংখ্যা হুহু করে বাড়তে থাকলো। দখল বাড়তে থাকলো সবখানে, আদিমতা ভেঙে কৃত্রিমতা নেমে এলো।
ঠিক এমনি একসময়ে উপন্যাসের আলোচক ছন্নছাড়া এক যুবক চাকুরির খোঁজে একরকম বাধ্য হয়ে বন বিভাগের চাকুরি পেয়ে চলে এলেন আরন্যক এক মৌজায়। তিনি নিজেকে নতুন করে খুঁজে পেলেন যেন এখানে। আজব সব গাছ, মানুষ, বন্য প্রাণী, অদ্ভুত আচার, দেবতাগন, প্রেম, পাহাড়, রাজনীতি সব মিলেমিশে একাকার হলো এখানে। অদ্ভুত সুন্দর সব দিন-রাত কাটতে লাগলো তার। জোৎস্নায় ভেজা বন, পাহাড়ি রাত, হাজার পাখির ডাক, বন্য হরিণের হাক, ঝিরি পথ, বন্য জন্তুর আক্রমণ, পাহাড়ি মানুষের যাপিত জীবন, রাজার হারিয়ে ফেলা সাম্রাজ্য, অবলা পাহাড়ি নারী, উচ্ছল প্রেমিক প্রেমিকার আকুতি তাকে তীব্রভাবে টানতে লাগলো। সে মগ্ন হয়ে যেতে থাকলো, ভুলে গেল শহুরে অতীত, ডুবে যেতে থাকলো সেই বন পাহাড়ে।
সবকিছুই ক্রমেই ফিকে হয়ে আসতে শুরু করলো। কোথায় যেন সুতোর তাল কেটে যেতে লাগলো। ক্রমে থেমে গেল ভাসমান মানুষের আনাগোনা, আড্ডা কিম্বা মেলা, বিশাল বনভূমি উজাড় হতে শুরু করল। মানুষে মানুষে দন্দ বাড়তে লাগলো। আর এই সবকিছুর মাঝে আরন্যকের ধীরগতির মৃত্যুর সূচনা হলো। গাছের, পাখির, সাপের, হরিণের, উপজাতি মানুষের অরন্য চলে গেলো বনখেকো মানুষদের কাছে। আরন্যক সাম্রাজ্যের পতন ত্বরান্বিত হতে শুরু করলো।
লেখক প্রসঙ্গে -
অদ্ভুত মাদকতাময় এই উপন্যাস বিভূতিভূষণের অনন্য এক সৃষ্টি। অপু ট্রিলজির (পথের পাঁচালী, অপরাজিত, অপুর সংসার) পরে আমার পড়া তার শ্রেষ্ঠ লেখা হলো এটি। এর বাইরে চাঁদের পাহাড়, আদর্শ হিন্দু হোটেলের মত পাঠক প্রিয় লেখাও তাকে সমৃদ্ধ করেছে সন্দেহ নেই। ওনার অধিকাংশ লেখায় প্রকৃতি, পরিবেশ, পরিবার, মানবিকতা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। অদ্ভুত এক মোহে আবিষ্ট করে রাখে সবাইকে। তাই যারা বিভূতিভূষণের কোন লেখা এখনো পড়েননি তাদের জন্য এই বইটি হবে আদর্শ বই। যারা নিরবতা পছন্দ করেন, অন্তর্মূখী স্বভাবের, প্রকৃতি যাদের টানে, জোৎস্না-পাহাড়-বৃষ্টি-পাখি-মেঠোপথ যাদের ভাল লাগে তাদের জন্য এই বইটি অবশ্যই সুখপাঠ্য।
বই: আরণ্যক
লেখক: বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
রিভিউ : শুভ্র মামুন