জীবনের সরল দর্শন: ছফার পুষ্প, বৃক্ষ ও বিহঙ্গ পুরাণ


শুধু বিষয়বস্তু নির্বাচন নয় বরং গদ্য শৈলীর কারণেও "পুষ্প, বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ" বইটি বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে থাকবে৷ গাছ, ফুল, পাখিও জীবনের ছায়া, জীবনকে গভীরভাবে বহন করে নিয়ে যায় অনন্ত অসীমে। বইটিতে আত্মজীবনীর ছায়া আছে, দার্শনিক ভাবধারা আছে, আছে ছফার জীবনবোধ। চৈত্রের এক  দুপুরে নীলক্ষেত থেকে বইটি সংগ্রহ করে টিএসসিতে পড়তে বসি। কয়েক পৃষ্ঠা পড়ার পর চৈত্রের তাপদাহের চেয়েও তীব্রভাবে বইটি আমার সত্তায় আঘাত হানতে থাকে। বইয়ের মূল কাহিনিতে আসা যাক,

আহমদ ছফার পালক পুত্র সুশীল কাঁটাবন থেকে খাঁচা সহ একটি শালিক পাখি চারতলার চিলেকোঠার বাসায় নিয়ে আসে। পাখিটি স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাসের জন্য ছোট খাঁচার পরিবর্তে বিরাট এক খাঁচা নিয়ে আসা হয়। খাঁচায় পর্যাপ্ত খাবার ও পানিতে পূর্ণ থাকা সত্ত্বেও পাখিটি খাঁচাকে তার স্বাধীনতার অন্তরায় ভেবে বের হওয়ার জন্য ছটফট করতে থাকে। একদিন পাখিকে গোসল করানোর সময় ছফার হাত ফসকে পালিয়ে যায়। কিন্তু পাখিটি একেবারে চলে যায়নি৷ খাবারের জন্য ছাদের আশেপাশে ঘুরঘুর করতে থাকে। শালিকের জন্য খাবার ছড়ানো হলে অসংখ্য পাখি খাবারে ভাগ বসাতে শুরু করে। 

আগত পাখিদের খাবার বিতরণ করলে দেখা যায় রাজ্যের তাবৎ কাকমন্ডলী খাবারের জন্য হানা দিতে থাকে। খাবার না দিলে দলেবলে কর্কশ কণ্ঠে তীব্র প্রতিবাদ জানায়। দেখা যায়, এক কাক অন্য কাকের খাবার খাওয়া সহ্য করতে পারে না যেমন সত্য, তেমনই কোন কাক মারা গেলে কা কা রবে শোকতাপ করে জনজীবন অতিষ্ঠ করে তুলে। কাকের যে বন্ধন সমাজের খারাপ মানুষের মধ্যে আমরা এমনতরো দৃঢ় বন্ধন সর্বদাই দেখে থাকি। অন্যদিকে দেখা যায়, ছফা যখন ছাত্রাবাসে থাকেন তখন কাঁটাবনের ফুটপাত থেকে একটি আহত বেগুন চারা কুড়িয়ে এনে ছাত্রাবাসের বাইরে রোপণ করেন। সেই চারাটির একাকিত্ব দূর করতে আরো বেগুন চারা রোপণ করেন।

ধাপে ধাপে ছাত্রাবাসের বাইরের মাঠটি বিরাট সবজির বাগানে রূপান্তর হয়ে যায়। একটা সময় এই সবজি গাছগুলোর সাথে ছফার আত্মিক সম্পর্ক স্থাপন হয়ে যায়। গাছেরা কষ্ট পেলে তিনি সে কষ্ট উপলব্ধি করেন। মনে হয় তার কথাও গাছেরা বুঝতে পারে। সবজি চাষাবাদের মধ্য দিয়ে একবার সাংবাদিক নাজিম উদ্দিন মোস্তান সাহেবকে নিয়ে ছফা কাঁটাবন বস্তিতে দরিদ্র বাচ্চাদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু বাচ্চাদের পড়াতে গিয়ে বিপত্তি বাঁধলো। 

বাচ্চাদের অভিভাবকরা তীর্যক এক প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, "আমাদের বাচ্চাদের পড়িয়ে আপনাদের লাভ কি?" অলাভজনক সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে কেন সফল হয়না তার একটি নমুনা এখানেই আমরা দেখতে পাই। লেখকের নির্মোহ ভঙ্গিমার একটি উদাহরণ দেখা যাক। আলমগীর নামের লাওয়ারিশ এক বাচ্চাকে ছফা তার কাছে আশ্রয় দিয়েছেন, ভালো পোষাক পরিচ্ছেদ দিয়েছেন, তাকে লেখাপড়া শেখানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ছফার সাথে যখনই আলমগীর থাকে তখন তাকে দেখে তার বন্ধুরা হাততালি দিয়ে হেসে উঠতো। কারণ জিজ্ঞেস করলেই চুপ করে যেত। একদিন আলমগীরের বন্ধু বাবুলকে জিজ্ঞেস করলেন এই হাসাহাসি কারণ কী?  বাবুল উত্তর দিলো, আলমগীর বলেছে আপনে তারে ফাকাইবেন।

 এধরণের নির্মোহ ভাষা ও ভঙ্গিমা ছফা ছাড়া অন্য কেউ প্রকাশ করতে পারতো কিনা আমার জানা নেই। তরুণ বয়সে প্রথমবার যখন বইটি পড়ি তখন কেবলই বৃক্ষ ও বিহঙ্গের কাহিনি দিয়ে সাজানো অতি সাধারণ ঘটনার সমষ্টি মনে হয়েছে। কিন্তু পরবর্তী পাঠে বুঝতে পারি গাছ ও পাখিদের উদাহরণ দিয়ে মনুষ্যসমাজের নানাবিধ সমস্যা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন। কোথাও কোথাও অনিয়ম অনাচারের বৃক্ষটি সমূলে উৎপাটন করে তা পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেছেন। পাখির জগতের হিংস্রতা ও জাতিবৈরিতার যে দৃষ্টান্ত লেখক দেখিখালেন তাতে প্রতীয়মান হয় শুধু মানুষ নয় প্রাণী জগতের প্রতিটি স্তরে সংঘাত ও বৈরিতা সাধারণ বৈশিষ্ট্য। 

লেখকের ভাষায়, ''মাটির মানুষের জগতে হিংস্রতা এবং হানাহানি দেখে আকাশের পাখির জগতে আমি আশ্রয় নিয়েছিলাম। সেখানেও হানাহানি এবং জাতিবৈরিতার প্রকোপ দেখতে পাচ্ছি। সুতরাং মানুষের মতো কর্তব্য পালন করার জন্য আমার মানুষের কাছে ফিরে না গিয়ে উপায় কী? আমি বৃক্ষ নই, পাখি নই, মানুষ। ভালো হোক, মন্দ হোক, আনন্দের হোক, বেদনার হোক আমাকে মানুষের মতো মানুষের সমাজে মনুষ্যজীবনই যাপন করতে হবে।''

 

বই: পুষ্প, বৃক্ষ ও বিহঙ্গ পুরাণ

লেখকঃ আহমদ ছফা 

রিভিউ: জহিরুল ইসলাম সাদ্দাম



Previous Post Next Post