ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট: মানব মনের বিচিত্র আখ্যান
ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট |
সিনেমার পর্দা থেকেও বাস্তব জীবনে মানুষ বেশি অভিনয় করে। ভাবছে এক, বলছে আরেক, করছে আবার ভিন্ন কাজ। শক্তের ভক্ত হচ্ছে, আবার কাওকে নরম পেলে যম হয়ে উঠছে। ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট হলো একেকজন মানুষের ঐ সব বিচিত্র আখ্যান যারা প্রতিনিয়ত অভিনয় করে চলছে কিন্তু জটিল পরিস্থিতিতে নিজের আসল চেহারা প্রকাশ হয়ে পরছে। মানব মনের এত সূক্ষ্মাতিসূক্ষা বর্ণনা আমি কোথাও পাইনি।
রাশিয়ান লেখক দস্তয়েভস্কির জীবন নাটকে পরিপূর্ণ। মানুষকে দেখেছেন খুব কাছ থেকে। মানুষকে পাঠ করা ছিলো তার প্রধান কাজ। মানব মনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে তিনি সাহিত্যে প্রয়োগ করেছেন। সাহিত্যে আধুনিকতাবাদ, অস্তিত্ববাদ, মনস্তত্ত্ব, ধর্মতত্ত্ব প্রভৃতি দর্শনে দস্তয়ভস্কির অবদান রয়েছে। মানুষ নিয়ে আদতেই তিনি আজীবন চর্চা করেছেন। নানাভাবে, নানা দিক দিয়ে তিনি মানুষকে পাঠ করেছেন। তাই তার লেখায় কখনো ফুটে উঠেছে মানুষের কুটিলতম, তমসাচ্ছন্ন দিক; কখনো আবার ঝলমলে প্রশংসা। মানুষ নিয়ে তার উভমুখী দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া পায় বিভিন্ন উপন্যাসে। ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র
রডিয়ন রাস্কোলনিকভ। নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান, তবে নিম্নরুচির পরিবার ছিল না তাদের। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ তার হয়েছে। ফলে বিশ্বজগৎ সম্বন্ধে ধ্যানধারণা গড়ে উঠেছে , বিশেষ বিশেষ তত্ত্ব সম্বন্ধে ও তার জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। সেই জ্ঞান এবং তত্ত্বের উপর নির্ভর করে দুটো খুন করে ফেলে গল্পের নায়ক এবং নিজেকেই নিজে জাস্টিফাই করে। আসলে পৃথিবীর কোন খুনই কি নিজেকে জাস্টিফাই করার মতো?
সোফিয়া এবং ডানিয়া দুইজন নারী চরিত্র। সমাজ ব্যবস্থায় নারীর অবস্থা এবং সংকট এর সাথে নিজের অবস্থান এত সুন্দরভাবে খুব কম বইয়ে আছে। এছাড়া সোফিয়া এর পিতা চরিত্রের অপরাধবোধ দারুণ ভাবে ফুটে উঠেছে, ডানিয়া এর মা চরিত্র সমাজের আদি ভাবনা এবং ব্রোকার বুড়া মহিলা চরিত্র অনবদ্য সৃষ্টি। এসব চরিত্র ব্যাখ্যা করা যায় না, পড়তে হবে, বুঝতে হবে।
ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট উপন্যাসের মূল কথা একজন মানুষের তীব্র মনস্তাত্ত্বিক লড়াই। সেখানে সে মূলত নিজের সঙ্গে নিয়ে লড়াই করে। নিজের অতীত বিশ্বাসের সঙ্গে যে ভাবত একজন সুপারম্যান সমাজের বৃহত্তর প্রয়োজনে একজন ঘৃণিত নিকৃষ্ট মানুষকে খুনও করতে পারে। তাতে সমস্যার কিছুই নেই, বরং তা প্রয়োজনবাদী দিক থেকে যুক্তিগ্রাহ্য। কিন্তু বাস্তবে এরকম একজনকে খুন করে ফেলার পর ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’ এর নায়ক রাস্কোলনিকভ তীব্র মানসিক সমস্যার মুখোমুখি হয়। একসময়ে সে যে ভেবেছিল এই খুন করার আইনী ন্যায্যতা থাকুক বা নাই থাকুক, নৈতিক ন্যায্যতা আছে। সেই ভাবনা সৌধটির ধূলিস্যাৎ হয়ে যাবার কথাই ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট এ দস্তয়েভস্কি সবিস্তারে বলেছেন।
মানুষের দুঃখগুলো একান্ত ব্যক্তিগত। এই জগতে কেও প্রবেশ করতে পারে না। নিজের জগতে নিজেও কি প্রবেশ করতে পারে? লেখক এক মানব মনের গহীনে প্রবেশ করে তার সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো তুলে এনেছেন খুব সুন্দর ভাবে। অস্তিত্বের টানাপোড়েন, সংকট এবং উত্তরণ সবগুলো নিখুঁত বর্ননা করেছেন।
[ পরিবেশে বলতে চাই এই গল্পের গহীনে পৌঁছাতে তিনবার পড়েছি বইটা। আরো দশবার পড়তে পারবো। প্রতিবার মনে হচ্ছে নতুন কিছু আবিষ্কার করছি। চরিত্রের এত গভীরতা এত সুন্দর মনস্তাত্ত্বিক বর্ণনা আমি কোথাও পাইনি। যারা বইটি একবার পড়েছেন তাদের আরো একবার পড়ার এবং যারা পড়েননি তাদের অবশ্যই পড়ার আহবান করছি। আশাকরি বই কিনে টাকা এবং পড়ে সময় নষ্ট হবে না। দশ গুণ সুদ সহ উসুল হয়ে আসবে ]