ঢাকা শহরের প্রথম পাঠাগারের আদ্যোপান্ত

ঢাকা শহরের প্রথম পাঠাগারের আদ্যোপান্ত


ঢাকা শহরের গোড়াপত্তন হয় চারশো বছর আগে। ১৬১০ সালে সুবেদার ইসলাম খান ঢাকায় বাংলার রাজধানী স্থানান্তর করলে একটা বদ্ধ জলাভূমি শহরে রুপান্তর হতে থাকে। সেই সাথে বাড়তে থাকে ঢাকার কদর। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির কদর্য তখন থেকেই। কিন্তু মেধা বিকাশে তখনো বাংলায় গর্ব শুধু মাত্র বিহারগুলো। তাও সেগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। শহরের গোড়াপত্তনের আড়াইশো বছর পরে ১৮৬৯ সালে সর্বপ্রথম ঢাকায় পাঠাগার স্থাপন করা হয়।

ঢাকায় স্থাপিত প্রথম পাঠাগারের নাম রাজা রামমোহন রায় পাঠাগার। যেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, জীবনানন্দ দাশের মতো বিখ্যাত কবি সাহিত্যিক দলের পদধূলি পড়েছে। এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরও সেখানে এসেছিলেন। সেই লাল ভবনটি আজও ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অথচ পাঠাগার কক্ষটি উধাও।

পুরান ঢাকার সদরঘাটে ঢোকার মুখে বাহাদুর শাহ পার্ক। ডান হাতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় রেখে সোজা আগালে পাটুয়াটুলী সড়কে ঢুকার মুখে চোখে পড়বে বিশাল এক লোহার গেট ওয়ালা লাল-সাদা বাড়ি। যাওয়া আসার পথে অনেকে হয়তো দেখেছেন বিশাল এই ভবনটি। কেও কৌতূহলী হয়ে ভেতরে ঢুকেছেন কি? ভেতরে ঢুকলে চোখে পড়বে ভবনের উপরে লেখা ব্রাহ্ম সমাজ। এই ভবনের পাশে মন্দির ভবনের সাথে ছিল পাঠাগার কক্ষটি। পরে ভবন নির্মাণ হলে ভবনের দ্বিগুণ তলায় স্থানান্তর হয় পাঠাগার কক্ষটি।

জেনে আরো অবাক হবেন যে, বুদ্ধদেব বসু, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কবি সুফিয়া কামাল, ড. কাজী মোতাহার হোসেন, আবদুল ওদুদ, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন ও কবি শামসুর রাহমানের মতো বিখ্যাত মানুষ সেই লাইব্রেরিতে বই পড়েছেন। কারণ সেখানে ছিল অনেক দুষ্প্রাপ্য বইয়ের সম্ভার।খ্যাতিমান কবি, সাহিত্যিক, লেখক ও বুদ্ধিজীবীর নিয়মিত আড্ডাস্থল ছিল সেই লাইব্রেরি।

মূলত ঢাকার ব্রাহ্ম সমাজ কর্তৃক পরিচালিত লাইব্রেরি হলো রাজা রামমোহন রায় পাঠাগার। ১৮২৮ সালে ব্রক্ষ সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন রাজা রামমোহন রায়। সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে ছিল তাদের কঠোর অবস্থান। যারা এক ঈশ্বর বা একেশ্বরবাদী ছিলেন তাদের প্রতিষ্ঠান ছিল এই ব্রাহ্ম সমাজ। রাজা রামমোহন রায়ের মৃত্যুর পর দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক। ১৮৪৭ সাল থেকে ঢাকায় ব্রক্ষ সমাজের আন্দোলন শুরু হয়। তখন এর সভা বসতো পাটুয়াটুলিতে এক ভাড়া বাড়িতে। মুনতাসীর মামুনের মতে ১৮৪৮ সালের দিকে ব্রক্ষ সমাজের কার্যক্রম পরিদর্শন করতে রবীন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকায় আসেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকায় আসেন ২ বার। প্রথমবার ১৮৯৮ সালে আর দ্বিতীয় বার আসেন ১৯২৬ সালে। ১৯২৬ সালে ৯ দিনের সফরে যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকায় আসেন তখন রাজা রামমোহন রায় পাঠাগারে এসেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ নবাব পরিবারের আহসান মঞ্জিলে আয়োজিত চা চক্রে অতিথি হিসেবে যোগ দেন। সেদিন সন্ধ্যায় পূর্ববঙ্গ ব্রাহ্ম সমাজ মন্দিরে অনুষ্ঠিত এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথকে মানপত্র প্রদান করে দীপালি সংঘ।

১৮৬৯ সালে ব্রাহ্ম মন্দির প্রতিষ্ঠার সময়ই ব্রাহ্ম সমাজের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক অভয় চন্দ্র দাশ মন্দির ভবনে রাজা রামমোহন রায় লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৭১ সালের ১৮ জানুয়ারি দ্বিতল ভবন তৈরি করে সেখানে প্রতিষ্ঠা করেন পাঠাগারটি। যা এখন আর সেখানে নেই। ভবনটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় রাজা রামমোহন রায় পাঠাগার সেখান থেকে সরিয়ে আবারও মন্দির ভবনে নেওয়া হয়েছে।

এখানে পাঁচ হাজারের বেশি দুষ্প্রাপ্য বই ছিল। এছাড়া পাঠগৃহ ভরপুর ছিল দেশবিদেশের খ্যাতিমান লেখক, কবি, সাহিত্যিক, ধর্মীয় ও দার্শনিকদের বইপুস্তকে। কিন্তু ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাবিরোধীদের লুটপাটের পর দুষ্প্রাপ্য সেসব পুস্তক আর সংগ্রহ করা যায়নি। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে গেছে অনেক গ্রন্থ। ভবনটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে ২০০৯ একে ভেঙে ফেলার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়। পরে একে ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ঘোষণা করে সংরক্ষণের উদ্যোগের ফলে কংক্রিটে পরিণত হয়েছে এ ভবনটি। শুধু মরে গেছে এর প্রাণের লাইব্রেরিটি।

সদরঘাট বাহাদুর শাহ পার্ক থেকে একটু সামনে এগুলো হাতের ডানে চোখে পড়ে ব্রক্ষ সমাজ। মূলত একেশ্বরবাদী মানুষের প্রার্থনা স্থল এটি। এই ব্রক্ষ সমাজের দ্বিতীয় তলায় গড়ে ওঠে ঢাকা শহরের প্রথম পাঠাগার। এক সময়ের সমৃদ্ধ পাঠাগার কক্ষের সামনে এখন ঝুলছে এক সাইনবোর্ড সেখানে লেখা " ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ, সাবধানে ভেতরে প্রবেশ করবেন " ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের কারণে পাঠাগার কক্ষটি সরিয়ে নিয়ে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। অবশ্য কেও গিয়ে যদি জিজ্ঞেস করে তবে সদয় হলে ঝুঁকিপূর্ণ প্রবেশের অনুমতি মেলে।

লেখক : সাগর মল্লিক
শিক্ষার্থী, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।
Previous Post Next Post