“বই আর খবরের কাগজ আমার বন্ধু। এর মধ্যেই আমি নিজকে ডুবাইয়া রাখি”
- কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা ১৪৩
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নামের আড়ালে আমরা হারিয়ে ফেললাম একজন পাঠক মুজিবকে, একজন লেখক মুজিবকে। রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গী ছিলো বই, বিশেষ করে জেলখানায় একমাত্র সঙ্গী বই এবং খবরের কাগজ। কথার সূত্র ধরে বলতে হয় ফিদেল কাস্ত্রো সবচেয়ে বেশি বই পড়েছিলেন জেলে বসে। তিনি এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন আমি আন্দোলন সংগ্রাম করতে করতে যখন হাঁপিয়ে উঠি, বই পড়ার অবকাশ পায় না তখন জেলে চলে যায়। গিয়ে বই পড়ি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর রাজনৈতিক জীবনে ৪ হাজার ৬৮২ দিন জেলে ছিলেন। সুতরাং বলা চলে থালা বাটি কম্বল, জেলে খানা ছিলো মুজিবের সম্বল। জেলে যারা যায় নাই, তারা জানে না জেল কি জিনিস। কি অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে। সেই জেলে বসে বঙ্গবন্ধু লিখেছিলেন "অসমাপ্ত আত্মজীবনী"। কি দারুণ সেই লেখা, রাজনৈতিক এবং সাহিত্য কোন অঙ্গনের মানুষ বইটিকে এড়িয়ে যেতে পারবেন না।
"অসমাপ্ত আত্মজীবনী", "কারাগারের রোজনামচা", এবং "আমার দেখা নয়া চীন" গ্রন্থ তিনটি আমাদের সামনে শেখ মুজিবকে উন্মোচন করে নতুন আলোয়। নতুন মাত্রায় মুজিব আমাদের কাছে ধরা দেন এসব বইয়ের পাতায় ভর করে। সেই মুজিব হলেন লেখক শেখ মুজিবুর রহমান।
শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক একটা ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন কে তুমি?
ছেলেটি দৃঢ় কন্ঠে উত্তর করলেন " আমি কেও না, কিন্তু কেও হতে এসেছি "
সেই ছেলেটি অনেক কিছু হয়ে দেখিয়েছিলেন। বাংলাদেশ নামক একটি জাতির জনক হলেন। বঙ্গবন্ধু হলেন কিন্তু জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নামের আড়ালে আমরা হারিয়ে ফেললাম একজন পাঠক বঙ্গবন্ধুকে, একজন লেখক বঙ্গবন্ধুকে। এই লেখা শুধুমাত্র লেখক এবং পাঠক মুজিবকে স্বরণ করার চেষ্টা মাত্র।
শেখ মুজিব ছিলেন একজন নিবিষ্ট পাঠক, একজন বইপ্রেমী, একজন জ্ঞান পিপাসু মানুষ। সাহিত্যের প্রতি ছিল তাঁর ভিষণ ঝোক। লড়াকু জীবনের নানা পর্যায়ে, বিভিন্ন বক্তৃতা, বিবৃতিতে আমরা তার প্রমাণ পাই। বিশেষ করে কারাজীবনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গী ছিল বই আর পত্রিকা। কারাগারের দিনগুলোতে সকাল বেলা তিনি উন্মুখ হয়ে থাকতেন পত্রিকার জন্য, খবরের জন্য। কেবল সংবাদপত্র নয় অবসরে বইপড়াও ছিল বঙ্গবন্ধুর নিয়মিত অভ্যাস। দর্শন, সাহিত্য এবং রাজনীতির বইয়ের প্রতি ছিল তাঁর অমোঘ আগ্রহ। কারাগারে যখনই সময় পেয়েছেন তিনি নিজেকে ডুবে দিয়েছেন বইয়ের ভুবনে। বইপড়ার ব্যাপারে নিজস্ব একটা পছন্দও ছিল তাঁর।
বই পছন্দের কথা বঙ্গবন্ধু নিজেই লিখেছেন তাঁর কারাগারের রোজনামচায়:-
বন্ধু শহীদুল্লা কায়সারের ‘সংশপ্তক' বইটি পড়তে শুরু করেছি। লাগছে ভালোই।
- কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা ৬৩
বইপড়ার প্রতি তাঁর নেশা নানাভাবে জানা যায় তাঁর নিজেরই জবানবন্দিতে। শেখ মুজিব বলছেন,
“ঘরে এসে বই পড়তে শুরু করে আবার মনটা চঞ্চল হয়ে যায়”।
-কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা ৬৭
“হ্যারিকেনটা জ্বালিয়ে বই নিয়ে বসলাম। অনেক রাত পর্যন্ত লেখাপড়া করলাম”
- কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা ১২২
“আমি বইয়ের মধ্যে মন দিলাম”
- কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা ১২৩
পাঠক হিসাবে বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন সতর্ক পাঠক। বইপত্রের ব্যাপারে তাঁর নিজস্ব একটা পছন্দ ছিল। সামনে যা পাই, তাই পড়ি – মোটেও এমন ছিল না তাঁর রুচিবোধ। জীবনের উত্থান-পতন আর স্বপ্ন-সংঘাতের সাথে মিল রেখে বঙ্গবন্ধু পড়াশোনার বিষয় নির্বাচন করতেন। জেলে বসে তিনি বলেছিলেন নভেল পড়তে দেয়। প্রেমের গল্প যত পার পড়ো। একজন রাজনীতিক এগুলি পড়ে সময় নস্ট করে কি করে! রাজনীতির গন্ধ যে বইতে আছে তার কোনো বই-ই জেলে আসতে দিবে না। জ্ঞান অর্জন করতে পারব না, কারণ আমাদের যারা শাসন করে তারা সকলেই মহাজ্ঞানী ও গুণী। - কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা ১৬৭।
যেহেতু বঙ্গবন্ধু পাঠানুরাগী মানুষ ছিলেন তাই তাঁর পছন্দের লেখক তালিকাও ছিল বৈচিত্রময়। তিনি রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি শরৎচন্দ্র, কাজী নজরুল ইসলাম এর রচনারও গভীর অনুরাগী ছিলেন। এসবের পাশাপাশি ইতিহাস এবং বিপ্লবী সাহিত্যের প্রতিও শেখ মুজিবের আগ্রহ ছিল অন্যরকম। তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ তে রয়েছে ভারতভাগ নিয়ে রচিত আলান ক্যম্পবেল জনসন এর ‘মিশন উইথ মাউন্টব্যাটেন’ এর কথা।
বইপত্র ঘিরে শেখ মুজিবের বহু স্মৃতি, বহু ঘটনা। পরিবারজুড়ে ছিল তাঁর পাঠমগ্ন একটি পরিবেশ বঙ্গবন্ধুর ঘটনা বহুল জীবন প্রবাহ থেকে তাঁকে একজন রুচিশীল পাঠক হিসেবে আবিষ্কার করা যায়। বইয়ের প্রতি, পড়াশোনার প্রতি, নিত্যনতুন জ্ঞানের প্রতি তাঁর এ অনুরাগ ছিল মজ্জাগত। বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন বক্তৃতা, বিবৃতিতে আমরা তাঁর পাঠাভ্যাসের, সাহিত্যরুচির প্রমাণ নাই। বিশেষ করে ৭ই মার্চ এবং ১০ই জানুয়ারির দুটো ভাষণে সরল আবেগ আর জনমনের আকাঙ্খাকে তিনি যেভাবে ভাষার যাদুতে বাঙ্ময় করে তুলেছেন তার তুলনা আজো তৈরি হয়নি। তাঁর চিন্তার গভীরে প্রোথিত যে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি তার অনুরণন আমরা পাই সমগ্র জীবনব্যাপী। তাইতো তিনি রাজনৈতিক কবিও বর্ণিল পাঠরুচি আর চিরায়ত বাংলা সাহিত্যের প্রতি অন্তরের টান এক গভীর বোধের জগৎ তৈরি করে বঙ্গবন্ধুর মনে। তাঁর প্রতিটি কাজে, চিন্তায় আমরা তাঁর প্রতিফলন দেখি।