জ্ঞানের জগত বড়-ই অসাধারণ জগত। এখানে ভাব চলে না, চলে যুক্তি। এখানে ভালোবাসা হয় যুক্তিতে, আবেগে নয়। সবাই জ্ঞান হজম করতে পারে না, একমাত্র প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিরাই পারে। বরিশালের আরজ আলী মাতুব্বর তেমনি একজন প্রজ্ঞাবান মানুষ। যার লেখা সবাই হজম করতে পারেন না। অল্পবিদ্যা ভয়ংকরী টাইপের অনেকে আস্তিক নাস্তিক দ্বন্দ্বে গুলিয়ে ফেলেন ওনাকে। মাতুব্বর সাহেবের পরিচয় উনি একজন বই পড়ুয়া, তারপর একজন সমাজ সংস্কারক। আপনি যেটাই বলুন না কেন, ওনার বই পড়ুয়া সত্ত্বাকে অস্বীকার করতে পারবেন না। ওনার মৌলিক প্রশ্নগুলোকেও অস্বীকার করার উপায় নেই। আরজ আলী মাতুব্বরের লেখায় ধর্ম, জগৎ ও জীবন সম্পর্কে নানামুখী জিজ্ঞাসা উঠে এসেছে। তার লেখার মধ্যে সত্যের সন্ধানে, সৃষ্টির রহস্য, অনুমান এবং স্মরণিকা উল্লেযোগ্য। এসব লেখাগুলো সহ তার সমস্ত লেখাগুলো বর্তমানে আরজ আলী মাতুব্বর রচনাসমগ্র নামে প্রকাশিত হয়। আর এই সবকিছু জানতে হলে আমাদের জ্ঞানের রাজ্যে প্রবেশ করতে হবে। পড়তে হবে, জানতে হবে, ভাবতে হবে। তারপর আলোচনা করতে হবে। তাইতো তিনি বলেছেন,
" জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে শুধু আপন বিশ্বাসই নয়, সকল মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত। সকল ধ্যান-ধারণা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করা দরকার প্রতিটি জ্ঞান পিপাসু মানুষের। শুধু সীমাবদ্ধ পরিমন্ডলে আবদ্ধ হলে চলেনা। সীমানাকে অতিক্রম করে যেতে হবে ক্রমান্বয়ে। আর এর মধ্যে-ই ক্রমশ অতিক্রম করা যাবে নিজেকে।"
একজন আরজ আলী মাতুব্বর
আমাদের একজন আরজ আলী মাতুব্বর ছিলেন। যিনি অগাধ পান্ডিত্য আর দর্শন জ্ঞানে মাতুব্বর। যে সময়ে অক্ষর জ্ঞান নিয়ে মানুষের মাঝে টানাটানি ছিলো, তখন বিজ্ঞান, দর্শনের নানা শাখায় তার অবাধ বিচরণ। মাতুব্বর সাহেব একাধারে একজন দার্শনিক, একজন চিন্তাবিদ এবং একজন লেখক। তার দর্শন-চিন্তা অনেকের নাও পছন্দ হতে পারে। কিন্তু তার অধ্যবসায় এবং জ্ঞানকে কেও অস্বীকার করতে পারবেন না। যিনি নিজ চেষ্টা ও সাধনায় বিজ্ঞান, ইতিহাস, ধর্ম, দর্শনসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর অঘাট জ্ঞান অায়ত্ত করেছেন। সম্পূর্ণ নিজ চেষ্টায় কোনো রকম প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি ছাড়াও যে জ্ঞানী হওয়া যায় এরকম অনন্য উদাহরণ রেখে গেছেন আরজ আলী মাতুব্বর।
আমার আজকে আলোচনার মূল বিষয় মাতুব্বর সাহেবের লেখা সমূহ। কিন্তু তার আগে ওনাকে নিয়ে মূল যে বিতর্ক সেদিকে একটু আলোকপাত করা যাক। কথিত আছে, শৈশবে তার মায়ের মৃত্যুর পর মায়ের ছবি তোলার দায়ে গ্রামের মানুষ তার মায়ের জানাজা পড়াতে রাজি হয়নি। শেষে বাড়ির কয়েকজন লোক মিলে তার মায়ের সৎকার করেন। মূলত এই ঘটনা থেকে মূল বিতর্কের শুরু, মানে ছবি তোলার জন্য ধর্ম অবমাননা। চিন্তা করুণ আজকের সমাজে ছবি তোলা কত হরহামেশা ঘটনা! এর পরের বিতর্ক ওনার লেখা নিয়ে। যেখানে উনি সৃষ্টিকর্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। আচ্চা বলুন তো অবচেতন মনে কে এই প্রশ্ন করে না? সাহজ করে সবাইকে বলার সাহজ কতজন করেন? নিজের জ্ঞান চক্ষুকে উন্মোচন করে অবচেতন মনের কথা ব্যক্ত করেছেন যে ব্যক্তি সেখানে ধর্ম অালচ্য বিষয় নয়, বিষয় জ্ঞান। তিনি ভাববাদকে মূখ্য না করে বস্তুবাদী হওয়ার চেষ্টা করেছেন জ্ঞান দিয়ে। আর সবথেকে শেষ বিতর্ক মরণোত্তর দেহ দান নিয়ে। মৃত্যুর পর ওনার চক্ষু ও দেহ যেন কোন অসহায় মানুষের কাজে লাগে সেজন্য দেহ দান করেছিলেন আরজ আলী মাতুব্বর। আপনি এই কাজকে ধর্ম দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারেন না, কারণ মানবতাকে অস্বীকার করতে কেও পারবে না। এ-জন্য অালোচনার শুরুতে বলেছি এ-জগত জ্ঞানের জগত।
আরজ আলী মাতুব্বর রচনাসমগ্র
আরজ আলী মাতুব্বরের মোট গ্রন্থ সংখ্যা ১৫ টি। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য লেখা সত্যের সন্ধানে প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ সালে। তারপর সৃষ্টির রহস্য প্রকাশিত হয় ১৯৭৭ সালে। অনুমান ১৯৮৩ সালে ও স্মরণিকা প্রকাশিত হয় ১৯৮২ সালে। এই লেখাগুলো সহ আরজ আলী মাতুব্বরের সমস্ত লেখাগুলো এখন আরজ আলী মাতুব্বর রচনাসমগ্র নামে প্রকাশ করে থাকেন পাঠক সমাবেশ থেকে।
রচনাসমগ্র এক এ সত্যের সন্ধানে গ্রন্থটিকে স্থান দেওয়া হয়েছে। যেখানে অতি সাধারণ কিছু প্রশ্নকে অসাধারণ ভাবে তুলে ধরেছেন। অলৌকিক জগৎ সম্পর্কে মানব মনের প্রশ্নগুলো উত্থাপন করেছেন লেখক। তিনি প্রশ্ন করেছেন এবং নিজে সরাসরি উত্তর দেন নি, তিনি প্রশ্নের উত্তর চেয়েছেন ভাববাদ বিশ্বাসী মানুষদের কাছ থেকে। প্রশ্নগুলো সব ধর্মের জন্য অতি সাধারণ। বিশেষ কিছুর সাথে মিল খোঁজাটা বোকামি বৈ অন্য কিছু নয়।
বইয়ের সূচিপত্র লক্ষ করলে পাওয়া যায় সত্যের সন্ধান এবং লৌকিকদর্শন বিষয়ক প্রশ্ন কেন করেছেন তার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। এবং তারপর একে একে প্রশ্নগুলো প্রস্তাব করে গেছেন মাতুব্বর সাহেব।
প্রথম প্রস্তাব - [আত্মা বিষয়ক]
দ্বিতীয় প্রস্তাব - [ঈশ্বর বিষয়ক]
তৃতীয় প্রস্তাব - [পরকাল বিষয়ক]
চতুর্থ প্রস্তাব - [ধর্ম বিষয়ক]
পঞ্চম প্রস্তাব - [প্রকৃতি বিষয়ক]
যে মানুষটি জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন শুধুমাত্র বই পড়ে, সেই মানুষটির প্রশ্ন জিজ্ঞাসা গুলো কেমন হয় একটু জেনে দেখা দরকার। জানার নতুন অনেক মাধ্যম এসেছে। বাজারে অনেক বইপত্র এসেছে। বইয়ের প্রাপ্তি সহজ হয়েছে। কিন্তু একজন অারজ অালীর মতো বই পড়ুয়া নতুন কোন মানুষের জন্ম হয়নি এদেশে।
আরজ আলী রচনাসমগ্র দুই নং খন্ড
এই খন্ডে আছে তার সৃষ্টি রহস্য লেখাটি। মূলত সৃষ্টি তত্ত্ব নিয়ে ওনার জ্ঞান সংকলন এখানে বর্ণনা করা আছে। সৃষ্টি রহস্য যতটা ওনার লেখা তার থেকে অনেক বেশি ওনার জ্ঞানের সংকলন। সৃষ্টি তত্ত্ব নিয়ে বিভিন্ন বইয়ের নানা রেফারেন্স সহ উনি তুলে এনেছেন। মূলত বিজ্ঞান সম্মত বিষয় এখানে অালোকপাত করা হয়েছে।
এই খন্ডের শেষে ওনার বিভিন্ন বক্তব্য, এবং চিঠিপত্র সহ বিভিন্ন কিছু তুলে ধরা হয়েছে। ওনার লাইব্রেরি পরিচালনা, তার খরচের হিসাব সহ বিভিন্ন বিষয়, যা একজন আরজ আলীকে জানতে অনেকাংশে সাহায্য করে।
তিন নং খন্ড নিয়ে বেশি কিছু বলার নেই। কারণ এখানে যা অাছে তা একজন আরজ আলীকে জানতে অবশ্যই পাঠ্য। মূলত তাকে যারা জানতে চান, তিনি কি করতেন, কি করেছেন, কিভাবে বেড়ে উঠেছেন সে সবকিছু আছে এই খন্ডে। ভিখারির আত্মকাহিনী মূলত একজন আরজ আলীর জীবন কাহিনী। জ্ঞান, বিজ্ঞান, দর্শনে যার অঢেল অর্জন তার ব্যক্তি জীবন অজানা থাকলে অনেক কিছুই জানার বাইরে চলে যাবে। একজন আরজ আলীকে অজানা থাকলে, ওনার লেখা গুলো রিলেট করা সহজ হবে না। সুতরাং তিন নং খন্ডটি এরিয়ে যাওয়ার সূযোগ নেই। উপরন্তু বলা যায় সবার অাগে পড়া উচিত এই ভিখারির আত্মকাহিনী।
তিন খন্ডের আরজ আলী রচনাসমগ্র হলো পূর্ণাঙ্গ মাতুব্বর প্যাকেজ। মানে ব্যক্তি আরজ আলী থেকে শুরু করে তার লেখা, কাজ সবকিছু। বিশেষ করে তার সংগ্রামী বই পড়ুয়া জীবনের গল্প। যে জীবনে বই সহজলভ্য ছিলো না, কিন্তু অদম্য ইচ্ছে শক্তি ছিলো। যে সম্পূর্ণ নিজের শক্তি জোরে নিজেই এক জ্ঞানের জাহাজ। এখানে জ্ঞান আলোচনা হবে, কিন্তু সময়কে ভুলে গেলে চলবে না।
স্বশিক্ষিত কিছু মানুষ কেবল অর্জিত জ্ঞানেই রচনা করেছেন আপন মেধার ভূবন। কুসংস্কার,
অজ্ঞতা, ও ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে লিখে যেতে পেরেছেন। কিন্তু আমরা এইসব মানুষ গুলোকে জানলাম না, পড়লাম না তাদের লেখাগুলো।