সাদিয়া সুলতানার উপন্যাস : আজু মাইয়ের পৈতানের সুখ

সাদিয়া সুলতানার উপন্যাস : আজু মাইয়ের পৈতানের সুখ


একদা এক সময়ে তিস্তার ধার ঘেঁসে গড়ে উঠেছিলো একটা গ্রাম। কে, কবে, কখন গ্রামের গোড়াপত্তন করেছে কেউ বলতে পারে না। কিন্তু দাঙ্গা আর দেশ ভাগের সময়ে একটা গ্রাম ভেঙে ধর্মের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিলো দুটো পাড়া। মুসলমান পাড়া, আর হিন্দু পাড়া। নদী বোঝে না ধর্মের বিভাজন, তাইতো তিস্তা যখন নিয়ে যায় তখন সবকিছু উজাড় করে নেয়। তিস্তা দুই পাড়াকে নিজের গর্ভে টেনে নেয়। তবে নদীর থেকে মানুষ হাঁ বেশি বড়। মানুষ নিলে দিতে জানে না।

গল্পের প্রোটাগনিস্ট আজু মাই। যে ভূতপ্রেত পোষে, রাক্ষসী। মাটির সাথে বিশেষ সক্ষতা রয়েছে তার। আজুর ছোটবেলা এমন ছিলো না, কেমন ছিলো তা বলবো না। কারণ আসল টুয়িস্ট সেখানে রয়েছে। রাজধানী থেকে পাঁচশো কিলোমিটার দূরের একটা গ্রাম, যারা শহরের রাজনীতি বোঝে না, যুদ্ধ বোঝে না, স্বাধীনতা বোঝে না। একটা মেয়ে বোঝে নিজের সম্ভ্রমের জন্য যুদ্ধ, বাবা বোঝে নিজের সংসারের জন্য যুদ্ধ, মা বোঝে পরিবারকে আগলে রাখার যুদ্ধ। এই গল্প সেই একাত্তরের গল্প। যেখানে হানাদারদের ভয় নেই, ভয় আছে একদল ডাকাতের।

মার্চের হাওয়ায় দিন বদলের সুখ, আজু মাইয়ের পৈতানে সুখ নেই। কারণ বাবা গেছে শহরে। শহরে তখন মিলিটারি পরেছে, সে খবর তারা জানে না। উকিল পাখি মৈত্র, অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন, রাম কৃষ্ণ, সুনীল চক্রবর্তী, কালাচাঁদ রায়, আব্দুর রহমান সহ প্রমূখ ব্যক্তিদের তখন শহর থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সে খবর আজু মাই জানে না, সে জানে ঘরে চাল নেই৷ কিন্তু গঞ্জের দোকান খুলছে না ডাকাতদের ভয়ে। সে জানে বনে বাদারে ঘুরে বেড়ার সময় কে যেন তাকে চেপে ধরেছিলো তাই একটা দা লাগবে তার, যেটা তার নিত্য সঙ্গী হবে।

দেশে ডাকাতদের ভয়ে মানুষ ভারতে পালাচ্ছে। কিন্তু পালিয়ে বাঁচতে পারছে না। ওখানে গিয়ে মরছে কলেরায়। ডাঙায় বাঘের ভয়, পানিতে কুমিরে খায়।এসব খবর আজু মাই জানে না। সে জানে দু গ্রাম পরে ডাকাতেরা আস্থানা গেড়েছে। তারপর কি হলো তার জীবনে?

এমন অনেক গ্রাম আছে, যেখানে মুক্তিযুদ্ধ একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। অনেকটা গ্রামে ডাকাত পড়ার মতো। স্বাধীনতা উত্তর এবং পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে এমন কোন গ্রাম ছিলো না যেখানে ডাকাতদের ভয় ছিলো না, ঠিক তেমন ঘটনা ঘটে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে। কারণ যা অঘটন ঘটায় সব ঐ স্থানীয় জোচ্চোরের দল। ঠিক তেমনি একদল ডাকাত গ্রামটা লন্ডভন্ড করে দিয়ে গেলো। সেই গ্রামের গল্প আজু মাইয়ের পৈতানের সুখ।

মুক্তিযুদ্ধের সময় শহর থেকে অনেক দূরের একটা গ্রাম বা একটা পরিবার কেমন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে গেছে, মনে প্রশ্ন জাগে না? যুদ্ধ, স্বাধীনতা এসব যারা বোঝে না, তাদের পরিবার কেমন পরিস্থিতিতে পার করেছে দিন? সময়কাল মুক্তিযুদ্ধ, কিন্তু ঘটনা সামাজিক। হত্যা, লুণ্ঠন, খুন, গোলাগুলি নেই, আছে একটা পরিবার/গ্রাম/কিছু মানুষের আখ্যান।

নিজের অভিমত ব্যক্ত না করলে আমার এতকিছু বলা অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। আমি বা কেউ নতুন করে একটা মুক্তিযুদ্ধের বই কেন পড়বে? পড়বে কারণ এটা মুক্তিযুদ্ধের বই নয়, বইটি একাত্তরের একটা পরিবারের গল্প। একটা অঞ্চলের গল্প। বিশেষ করে রংপুর অঞ্চলের মানুষ কেউ যদি পড়ে তাহলে আমার থেকে বেশি সে উপলব্ধি করতে পারবে। আর বইয়ের শেষে একগাদা রেফারেন্স বইয়ের উল্লেখ দেখে বোঝা যায় কম খাটুনির ফল নয় এই বই। সুতরাং নতুন করে পুরনো কিছুকে জানতে আজু মাইয়ের পৈতানের সুখ।

বই: আজু মাইয়ের পৈতানের সুখ
লেখক: সাদিয়া সুলতানা
প্রকাশনী: চৈতন্য
মুদ্রিত মূল্য: দুইশত আশি টাকা


রিভিউ : সাগর মল্লিক
ইংরেজি বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়
Previous Post Next Post