শুধু বিষয়গত দিক থেকে নয় ভাষাগত, গঠনগত এমনকি বৈচিত্রের দিক থেকেও স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের একটি উপন্যাস। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের "আদর্শ হিন্দু হোটেল"। যার প্রতি পরতে পরতে আছে হাসি, কান্না, হতাশা, দুঃখ, ভয়, রোমাঞ্চ, ক্ষোভ, ক্রোধ আর এক হার না মানা সাহসী মানুষের জীবনের যুদ্ধ। এ এক সফল মানুষের গল্প মশায়েরা। এ হাজরা ঠাকুরের শূন্য থেকে শেখরে উঠার গল্প। গল্পটি বই আকারে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৪০ সালে।
উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র হাজারি দেবশর্মা, তার উত্থান পতনের সুচারু বর্ণনাই লেখক দক্ষ হাতে বইয়ের পাতায় তুলে ধরেছেন।
কে এই হাজারি ঠাকুর? মামুলি একজন হোটেলের রাঁধুনী বামুন। তার হাতের রান্নায় প্রচুর স্বাদ। তবু যেন নীরবে-নিভৃতেই তার যাপন। প্রাপ্য প্রশংসার আশায় চাতকের মত চেয়ে থাকে, কেউ ফিরেও চায় না। তাই দিনশেষে একটু দয়া পেয়েই নিজেকে ধন্য মনে করতে হয় তাকে। হাজারির কাছে তার পেশা অনেকটা নেশার মতোই। রান্না তার কাছে তেমনই, যেমন একজন শিল্পীর শিল্প। বয়সের রেখা তাকে ক্রমশ গ্রাস করছিলো, সাথে অস্বীকৃতির দায়। তার গুণেই যে হোটেলের খদ্দের বারবার ফিরে আসে, সে কথা কেউ মানেনি। না মানার দলে সর্বাগ্রে থাকে পদ্মঝি। হোটেলের মালিকের সাথে যার বড় ভাব, আর তাই অন্যদের উপর ছড়ি ঘোরাতে সে সিদ্ধহস্ত।
সাত টাকা মাইনের চাকরি থেকে নিজের হোটেল, স্বপ্নটা একজন রাঁধুনী বামুনের জন্য অনেক বেশিই। সততার পথ থেকে একটুও না সরে, তিল তিল করে টাকা জমিয়ে এবং কিছু অনাত্মীয় আপনজনদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে সে তার হোটেলের স্বপ্নের পথে একটু একটু করে পা বাড়ায়। কথায় আছে অর্থ অনার্থের মূল। কিন্তু জীবন ধারনের জন্য অর্থ যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বিভূতি তার কলমের যাদুতে তুলে এনেছেন। অনাত্মীয় মানুষও যে সম্পর্কে কতটা প্রিয় হয়ে উঠে তার বর্ণনা যে এত মাধুর্যপূর্ণ হয় তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ এই উপন্যাস। পরোপকার কিংবা মানব মনের বিভিন্ন অধ্যায় খুব চমৎকার ভাবে ফুটে উঠেছে বইয়ে। মনস্তত্ত্বের ভিন্ন ভিন্ন মাত্রার ব্যাখ্যাও পাওয়া যায় এই উপন্যাসে।
বিভূতিভূষণের বৈচিত্র্যময় বর্ণনা, ভাষার কারুকাজ, আর বর্ণনার নৈপুণ্যে গড়া উপন্যাস “আদর্শ হিন্দু হোটেল”। বিভূতির প্রায় প্রতিটি লেখাতে তিনি মানব জীবনের সাথে প্রকৃতির একটা অদ্ভুত মেলবন্ধন ঘটিয়ে থাকেন। কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে যায় মানুষ আর প্রকৃতির মধ্যবর্তী সূক্ষ্ম প্রাচীরখানি। মানব মনের সাথে প্রকৃতির সেতুবন্ধন বা সংযোগের বিষয়টা লেখকের এ বইয়ে স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত।
রিভিউ : সাগর মল্লিক
শিক্ষার্থী, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়