সাতকাহন - এক মেয়ের নারী হয়ে উঠার উপাখ্যান!

সাতকাহন - এক মেয়ের নারী হয়ে উঠার উপাখ্যান!

কে এই দীপাবলি? শুধুমাত্র উপন্যাসের নায়িকা নাকি বাস্তব জগতে এই মেয়ের কোন অস্তিত্ব আছে? একটা জীবনের কাহিনী এত সুন্দর ভাবে চিত্রিত করা বাংলা সাহিত্যে বিরল। দীপাবলি কি শুধুমাত্র লেখকের কল্পনা? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে জানতে হবে লেখককে। বাংলা সাহিত্যে সমরেশ মজুমদারের কোনো জুড়ি মেলা ভার। সাতকাহন থেকে শুরু করে গর্ভধারিণী, সহজ সরল ভাষায় খুব স্বাভাবিক ভাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন জীবনের সব স্তরের চিত্র। লেখককে একবার প্রশ্ন করা হয় আপনি কি দীপাবলিকে কাছ থেকে চিনেন? খুব ছোট্ট সাদামাটা উত্তর,  হ্যা আমি যেখানে থাকতাম সেই পাড়াতে দীপাবলি থাকতো, আমার প্রতিবেশী ছিলো। একজন মেয়ে হিসাবে আপনাকে এই মেয়ের নারী হয়ে উঠার উপাখ্যান অবশ্যই পড়তে হবে। আর পুরুষ হিসাবে আপনি যদি এই উপন্যাস পাঠ করেন তবে অবশ্যই বলবো নারীকে অসম্মান করার আগে দ্বিতীয়বার ভাবতে বাধ্য হবেন।


লেখকের সঙ্গে গল্পের বাস এবং উপন্যাসের  মধ্য কথা

তখন বাংলা ১৩৯৭ সাল, লেখকের শৈশব কাটে পশ্চিমবঙ্গের ডুয়ার্সের চা বাগানে। হয়তো সেখানেই সাক্ষাৎ মেলে এই দীপাবলি চরিত্রের সাথে। কেননা সাতকাহনে দেখতে পাওয়া যায় চা বাগানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব সুন্দর বর্ণনা। যেখানে বেড়ে উঠছে এক দুরন্তপনা বালিকা। চা বাগানের সহজ সরল জীবিকা এই উপন্যাসের অন্যতম উপজীব্য বিষয়। অধিকাংশ পাঠক এড়িয়ে যান যে বিষয়টা তা হল, উপন্যাসের বর্ণিত এলাকায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি, নগর গড়ে উঠার কারণ এবং সাথে সাথে জীবিকার পরিবর্তন। দীপাবলির কঠিন হয়ে ওঠার সাথে সাথে চারপাশের পরিবেশটাও কেমন যেন কঠিন হয়ে উঠেছে এই বিষয়টা দীপাবলি চরিত্রের আড়ালে মলিন হয়ে থাকে। কারণ উপন্যাসের শেষে সহজ সরল দীপাবলির পরিবর্তে এক কঠিক দীপাবলিকে চোখে পড়ে।

সাতকাহন সমরেশ মজুমদার

সাতকাহন কোন বিষয়কে নির্দেশ করে?

সাতকাহন উপন্যাসটিতে বিংশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে পুরুষশাসিত সমাজে নারীর অবস্থান তুলে ধরার পাশাপাশি প্রকাশ পেয়েছে নারীবাদী চেতনা। প্রোটাগনিস্ট দীপাবলি জলপাইগুড়ির চা বাগানে বড় হওয়া এক কিশোরী যার জীবনের ঘাত প্রতিঘাতের গল্প এই সাতকাহন। আপোষহীন-সংগ্রামী এই নারী চরিত্র নিঃসন্দেহে সমরেশ মজুমদারের অন্যতম সেরা সৃষ্টি। পুরুষশাসিত সমাজের বিরুদ্ধে লড়াকু যোদ্ধার গল্প। যে গল্প হাজারো মেয়ের জীবনকে বাঁচতে শেখায়। শুধুমাত্র বেঁচে থাকা নয়, আমি মনে করি নারীশিক্ষার বিষয়টিও গুরুত্বের সাথে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে উপন্যাসে। যে উপন্যাস অনেক নারীকে বাঁচতে শেখায়।


কাহিনি সংক্ষেপ এবং বিষয় পর্যালোচনা

উপন্যাসটি মূলত নারী কেন্দ্রিক একটি গল্প। সমাজের অনেক নিচু স্থান থেকে একজন মেয়ের উপরে উঠে আসার গল্প। মাত্র দশ বছর বয়স থেকেই দীপাকে অতিক্রম করতে হয়েছে নানা বাঁধা বিপত্তি, মুখোমুখি হতে হয় কিছু অপ্রিয় সত্যের। চেনা জগত টা চট জলদি অচেনা হয়ে যায় দীপার। কিন্তু তবুও দীপা থেমে থাকেনি। নিরন্তর চেষ্টা চালিয়েছে নিজের সম্মান প্রতিষ্ঠার। নিজের মেধা কে কাজে লাগিয়ে অর্জন করেছে সাফল্য কিন্তু সাফল্য অর্জনের এই পথ মোটেও সহজ ছিল না দীপার জন্য। প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হয়েছে সমাজ,পরিবার এমনকি মাঝে মাঝে নিজের সাথেও। একজন নারী যে পুরুষের চেয়ে কোনো অংশে কম না তা দীপাবলি বুঝিয়ে দিয়েছে চোখে আঙুল দিয়ে। নারী বা পুরুষ নয়, সমাজে সবাই সমান।

দীপাবলী ছাড়াও আরো অনেকগুলো নারী চরিত্র এসেছে উপন্যাসটিতে। আমার মনে হয়েছে  দীপাবলীর দাদি মনোরমা সেকালে মানুষ হয়েও অনেকের চেয়ে আধুনিক।চা-বাগানকে ঘিড়ে যাদের জীবিকা, তাদের জীবন কেমন হয় তার চমৎকার বর্ননা পাওয়া যায় বইটিতে। বর্ননাগুলো এতই নিখুদ ছিল যে,পড়ার সময় আমি চা-বাগানে ঝিরঝর করে বৃষ্টি পরার ছবি দেখতে পেয়েছি। পঞ্চাশের দশকে ভারতে এমন আনেক জায়গা ছিল যেখানে তখনও কারেন্ট পৌছায়নি এই উপন্যাসের চা-বাগানটিও সেধরনের একটি জায়গা। যেখানে সভ্যতার পদচারণা সবে শুরু হয়েছে। সভ্যতার শুরু থেকে একটি জনপদের গোড়াপত্তনের গল্প বললেও ভুল হবে না।

সমাজের ঘুনেধরা সংস্কারের বিরুদ্ধচারণ করে সমাজে নিজের অবস্থান তৈরি করেছে এক মেয়ে। সাধারনের মাঝেই দীপাবলির গল্প অসাধারণ। গল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তার চরিত্রের বিকাশ এবং জীবনবোধের পরিবর্তন গল্পটিকে অন্য এক রুপ দিয়েছে। বাংলার প্রতিটি নারীই দীপাবলির মাঝে অল্প হলেও নিজকে খুঁজে পাবে। কেউ হয়তো তার উপর হয়ে যাওয়া অন্যায় গুলোর স্বীকার আবার কেউ হয়তো তার মত অন্যায়ের বিরুদ্ধচারী।

সাধারনের মাঝেই দীপা অসাধারন। যার জীবনে এসে মিশেছে নানা নাটকীয়তা, আর এসব নাটকীয়তাকে ছাপিয়েই যার জীবন এগিয়ে গেছে। চরিত্রটি নিজ স্বকীয়তায় পরিপূর্ণ। লোভ, ঘৃনা,প্রেম, রিপুর তাড়না, বাঁচার ইচ্ছে, উচ্চাকাংক্ষা সব মিলিয়ে

সমরেশ মজুমদারের সাতকাহনের দীপাবলী। দুই খন্ডের বিশিল উপন্যাসটি পড়তে পাঠকদের কখনওই একঘেয়েমি লাগবেনা।

পাঠক হিসাবে আমার অভিমত

কিছু বই আছে যেগুলো পড়ার সময় সাহিত্য বিচার করতে নেই। আর যদি বিচার করতে বসা হয় তখন খুঁত খুঁজে পাওয়া যায় না। ঠিক তেমনি এক বই সাতকাহন। পড়ছে আর দীপাবলিকে যতই চিনেছি ততই অবাক হয়েছি। কখনো মনে হয়েছে দীপা আমার বোন আবার কখনো তার সাহসের সাথে নিজেকে তুলনা করতে পারিনি। বিংশ শতাব্দীর নারীদের চিন্তা যে কতটা আধুনিক ছিল তা এই উপন্যাস না পড়লে বুঝতাম পারা যায় না।দীপবলি, রমলা সেন আর মায়ার আধুনিকতা দেখে নিজের চিন্তাচেতনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছি। আমাদের সমাজে একটি মেয়ের অবস্থান কোথায় তারই কিছু বাস্তব চিত্র এই উপন্যাস দেখিয়েছেন সমরেশ মজুমদার। মূল চরিত্রে দেখানো হয়েছ দীপাবলী নামের একটি সাহসী মেয়েকে। কিন্তু উপন্যাসের দ্বিতীয় ভাগ পড়ার সময় আপনার দীপা চরিত্রের উপর বিতৃষ্ণা আসতে পারে। লেখক যে শেষ টুকু এমন করলে বুঝে উঠতে পারলাম না। যেমন চলছিলো বেশ ছিলো কিন্তু হটাৎ চরিত্রের এমন আচরণ মেনে নেওয়া যায় না। পরিশেষে দীপার অনিদিষ্ট গন্তব্যের একরাশ মায়া নিষে শেষ করতে হবে এই বই। তবে পরিবারের উপর নূন্যতম কর্তব্য দীপার উপর বর্ষণ করলে গল্পটি সার্থক হতো বলে মনে করি।

••••

রিভিউ :

সাদিয়া তাবাসসুম

শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Previous Post Next Post