শিল্পী মনে আঁকিবুকি খেলে কত যে ভাবনা। সেই ভাবনার জগতে কখনো অবগাহন করেছেন? শিল্পী মনের মনস্তাত্ত্বিক পাঠে ডুব দিতে আলাউদ্দিন আল আজাদের "তেইশ নম্বর তৈলচিত্র" এর জুড়ি মেলা ভার।
বাংলা সাহিত্যের আকাশে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম আলাউদ্দিন আল আজাদ। কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটকসহ সাহিত্যের বিচিত্র শাখায় তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। পাকিস্তান সৃষ্টির পর মুসলিম জাতীয়তাবাদের ঊর্দ্ধে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যিনি মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন তিনিই এই আলাউদ্দিন আল অাজাদ। মাত্র দেড় বছর বয়সে মা এবং দশ বছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে অভিভাবকহীন এই লেখক। জীবন সংগ্রামে নিজেকে চিনেছেন। বিচিত্র পাঠাভ্যাস ও সাধনার মাধ্যমে নিজেকে প্রস্তুত করেছেন সাহিত্যজগতের জন্য।
তেইশ নম্বর তৈলচিত্র' আলাউদ্দিন আল আজাদ রচিত প্রথম এবং শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। একজন চিত্রশিল্পীর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ এবং শিল্পীর জীবন ও প্রেমকে কেন্দ্র করে এ উপন্যাসের ঘটনা আবর্তিত হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের মনস্তাত্ত্বিক ধারায় এটি একটি অন্যতম সংযোজন। একজন চিত্রশিল্পীর জীবনের অনুভব এবং তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রেম ও প্রাণের স্বরূপ এ উপন্যাসে নতুন রূপে বিশ্লেষিত হয়েছে। ১৯৬০ সালে ‘পদক্ষেপ’ পত্রিকার ঈদসংখ্যায় এ উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয়।
চিত্রশিল্পী জাহেদের আপন ভাষ্যে এই উপন্যাসটি লিখিত হয়েছে। আর্ট স্কুলের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র জাহেদের সঙ্গে রঙের দোকানে হঠাৎ করেই পরিচয় ঘটে জামিলের। জামিলের অনুরোধে তাকে বিজ্ঞাপন আঁকার কাজে সাহায্য করতে গিয়ে ছবির সঙ্গে জাহেদের পরিচয় হয়। ছবির সাদামাটা মায়াময়ী ভাব অতি দ্রুতই জাহেদকে তার প্রতি আকৃষ্ট করে ফেলে। ছবির আকর্ষণেই জাহেদ বারবার জামিলের বাড়িতে যেতে থাকে। একপর্যায়ে জাহেদ ছবির প্রতি ভালবাসা অনুভব করতে শুরু করে এবং শীঘ্রই দুজন দুজনকে গভীরভাবে ভালবেসে কাছে আসে। মূলত, প্রেমের উত্থান এবং প্রেমকে লালন করার তীব্র সৌন্দর্যের বর্ণনার মাধ্যমে উপন্যাসটির সূচনা ঘটে। কিন্তু বন্ধন যে সত্যিকারের শিল্পী হওয়ার পথে অন্তরায় নাকি এই প্রেমই শিল্পী হওয়ার পথকে উন্মোচন করে। অাসলেই কি ঘটেছিলো এই প্রেমিক যুগলের জীবনে। ছবির শরিরে যে মাতৃত্বের দাগ স্পষ্ট।
না, এ কোন প্রেমের উপন্যাস না। বরং বাংলার হাজারো যুবকের প্রনয় গাথার এক আদর্শ দৃষ্টান্ত।তেইশ নম্বর তৈলচিত্র বাঙালি সমাজের আদর্শ প্রেম শিল্পের এক মহান শিল্পকর্ম। সে সব যায় হোক কিন্তু মোদ্দা কথা হল এই উপন্যাসের নায়ক কে? জাহেদ, জামিল, কথক নাকি বাংলার হাজারো যুবক? সে বিচার কিন্তু পাঠকের!
১৯৬০ সালে প্রথম প্রকাশিত হলেও এতটা বছরে উপন্যাসটির আবেদন এতটুকু কমেনি। মূলত, লেখকের ছন্দময় লেখার প্রাঞ্জলতা, জীবনকে সূক্ষ্মভাবে দেখার সক্ষমতা এবং লেখার কাব্যিক সাবলীল ভঙ্গির জন্য উপন্যাসটি এক অপরূপ স্নিগ্ধতায় ভরে উঠেছে। মাত্র ক পাতার একটি উপন্যাস চাইলেই হয়তো এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলা যাবে। কিন্তু এর রেশ থেকে যাবে বহুক্ষণ। কোন হৃদয়ে হয়তো দাগ কেটে থাকবে সারাজীবন।