ছোট গল্পের ইশ্বর : সা'দত হাসান মান্টো

সা'দত হাসান মান্টো ছিলেন উপমহাদেশের ইতিহাসে এক কিংবদন্তী। সাহিত্যের আকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্র।
সামাজিক এবং রাজনৈতিক বিদ্রোহের সাথে যৌন বিদ্রোহও যার লেখায় প্রকাশ পেয়েছে। যিনি দেশভাগের শ্রেষ্ঠ কাহিনিকার তো বটে, এই উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ গল্পকারও। কিন্তু আমরা তাঁকে জানলাম না, পড়লাম না তাঁর লেখাগুলো।  উপমহাদেশীয় সাহিত্যের এই উজ্জ্বল নক্ষত্রের জন্ম-মৃত্যু দিন চলে যায় মোটামুটি নিঃশব্দেই।

গাঞ্জে ফেরেশতে, ঠান্ডা গোশত, লাউডস্পিকার, কালো সীমানা, গল্প লেখক ও অশ্লীলতা, জানাযে, টোবাটেক সিং ও অন্যান্য বইগুলো যারা পড়েছেন তারা বুঝবেন গল্পের শক্তি কাকে বলে! দেশ ভাগ এবং যৌন বিদ্রোহ স্পষ্ট এই লেখাগুলোতে।

সা'দত হাসান মান্টো ছিলেন উপমহাদেশের দাঙ্গা ও দেশভাগের শ্রেষ্ঠ কথাকার। এই নিয়ে আজকের দিনে কেউ আর আপত্তি করবে না, অন্তত তাকে যারা জানেন। দেশভাগের যন্ত্রণা, ছিন্নমূল মানুষের হাহাকার, দাঙ্গার আতঙ্ক, সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত বিদ্বেষ, এমনকি সাহিত্যে যৌনতার বিষয় সবকিছু এত নিপুণ দরদে আর কেউ চিত্রিত করেছেন বলে মনে হয় না! দেশভাগের সময় মান্টো চলে যান পাকিস্তানে, আর দুর্ভাগ্য হয় আমাদের। মান্টোর অধিকাংশ রচনাই উর্দুতে, আর ভারতের শত্রুরাষ্ট্র পাকিস্তান। তাই উর্দু ভাষার চর্চাকে ভারতে সর্বতোভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। এদিকে বাংলাতেও খুব বেশি অনুবাদ হয়নি। তাই শিক্ষিত সাহিত্য পাঠকের সংকীর্ণ গণ্ডির বাইরে মান্টো সে ভাবে চর্চিত হলেন না।

দেশভাগের কারণে যে মানুষগুলোর জীবন তছনছ হয়ে গিয়েছিল, সাদত হাসান মান্টো তার মধ্যে অন্যতম। পাকিস্তানে যে ক'বছর তিনি বেঁচে ছিলেন, সেই বছরগুলোতে লেখক হিসেবে তাকে খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। জীবিকা উপার্জনের জন্য পাকিস্তানেও যোগ দিয়েছিলেন ফিল্ম কোম্পানিতে। লাহোরের সিনেমাজগৎ তখন সবে বুঝতে শুরু করেছে তার সামনে বিশাল সম্ভাবনা। কিন্তু পরপর দু-দুটো চলচ্চিত্র ফ্লপ হওয়ায় পাকিস্তানী ফিল্মেও খুব বেশি ভালো অবস্থান জোগাড় করে উঠতে পারেননি। এদিকে মান্টো ততদিনে প্রগতিশীল ঘরানা থেকে ধর্মবাদী মানুষ আর রাষ্ট সবার সমানে চক্ষুশূল।

জীবন যখন দূর্বিষহ, বেঁচে থাকা তখন সময় মাত্র, কারণ সংসার চালানোর টাকা জোগাড় করাই কঠিন হচ্ছে দিনকে দিন। এদিকে ইংরেজ সরকারের অশ্লীলতার অভিযোগ করা মামলা নতুন দেশের সরকার উঠিয়ে নেয়নি। আমৃত্যু সেই বোঝা তাঁকে বইতে হয়েছে। তাঁর লেখা ছাপতে পত্রিকার সম্পাদক ভয় পান, কখন পত্রিকা বন্ধের খাঁড়া নেমে আসে, কে জানে! বিকেল হলেই বেরিয়ে পড়েন মান্টো। পত্রিকা অফিসে গিয়ে নাছোড়বান্দার মতো টাকা চান, সম্পাদক কাগজ কলম এগিয়ে দিয়ে বলেন—মান্টো সাহেব, টাকা নিন আর কিছু একটা লিখে দিন। মদ আর বাজার খরচের টাকার জন্য দুশ্চিন্তিত লেখক লিখে দেন কাঁপা কাঁপা হাতে। সেই গল্প কখনো কেবল এক লাইন, বেশি হলে পৃষ্ঠা দেড়েক। এভাবে লেখা ৩২টা গল্প নিয়ে ১৯৪৮ সালে বের হয় এক বই "সিয়াহ হাশিয়ে"। মজার ব্যাপার হলো, পাকিস্তানে থাকাকালে লেখক হিসেবে তাকে খুব বেশি গুরুত্ব দেয়া না হলেও তিনি সেসময় যেসব গল্প লিখেছিলেন, সেগুলোকেই তার সেরা সাহিত্যকর্ম হিসেবে ধরা হয়।

এই বই মান্টো আর প্রগতিশীল লেখক সংঘের মধ্যে বিচ্ছেদের কারণ হলো। এবার প্রগতিশীল লেখক সংঘের সঙ্গে মান্টোর বিচ্ছেদ চূড়ান্ত হয়ে গেল। মান্টো বন্ধুহীন হয়ে পড়লেন। বন্ধু বলতে রইল তারা, যারা তাঁকে সস্তা মদ জোগাড় করে দেয়, আর যারা তাঁর মৃত্যুকে এগিয়ে নিয়ে এসেছিলেন।

তবে এসবের মধ্যে তিনি ভারত ভাগের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজও শুনিয়ে গেছেন রক্ত হিম করা গল্প। গল্পগুলো শোনাচ্ছেন সেই দেশগুলোতে, যেখানে ইতিহাস হিসাব করে অবহেলা করা হয়, যে দেশগুলোতে বর্তমানের শাসন অনুযায়ী অতীতও পাল্টে যায়। ইতিহাস প্রকল্পের সামনে মান্টো একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন। বেঁচে থাকতে তিনি যেমন অনেকের কাছে অস্বস্তিকর ছিলেন, মরে গিয়ে ঝাঁজ যেন আরও বেড়েছে। সাময়িক কর্তার খায়েশ অনুযায়ী বদলে যাওয়া ইতিহাসের আসল পাঠ নিতে গেলে মান্টোর তুলনা নেই।বিশেষ করে, যে ইতিহাস এমন অস্বস্তিকর, অনিশ্চিত আর বিপজ্জনক বর্তমান তৈরি করেছে। মান্টো নিজে সে কথা জানতেন।

বেঁচেছেন মাত্র ৪৩ বছর। কিন্তু লিখে গেছেন কী প্রবল উদ্যমে! ২২টি ছোটগল্পের সংকলনে মোট ১৩২ টি ছোটগল্প, ১টা উপন্যাস, রেডিও নাটকের ৭টা সংগ্রহ, ৩টা প্রবন্ধ সংকলন আর ২টা চেনা মানুষদের স্মৃতিকথা! তাঁর লেখা সিনেমার চিত্রনাট্যগুলো এক করে ছাপানো হয়েছে বলে জানা যায় না। এগুলোর একটা উল্লেখযোগ্য অংশ লিখেছেন দুই দানবের জন্য—মদ আর সংসার।

দেশভাগের প্রতিদিনের বাস্তবতা, তার আতঙ্ক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে ছাপিয়ে আমাদের আজকের চেতনা আর অবচেতনায় সমানভাবে হানা দেয়। সমকালে রামুতে পোড়া মন্দিরের ছাইয়ের মধ্যে স্মিত হাসির বুদ্ধ, গুজরাটের দাঙ্গা, পাকিস্তানের শিয়া মহল্লায় নির্বিচার আগুন বা খ্রিষ্টানদের প্রার্থনার সময় নির্বিচার গুলিবর্ষণ মান্টোকে বারবার ফিরিয়ে আনে। কিন্তু তিনি আজ সহজে কোনো শরীর খুঁজে পান না, যে শরীর মাত্র ৪৩ বছর বয়সে নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার সাহস রাখবে।
Previous Post Next Post