"সকল পূর্ণিমা এক নয়। কোনো পূর্ণিমায় মানুষ সব হারায়। কোনো পূর্ণিমায় মানুষ সব পায়। চাঁদের তাতে কিছু আসে যায় না। সে নিরাসক্ত থেকে নিজেকে নিঃশেষ করতে থাকে পূর্ণিমা থেকে"।
বইয়ের নাম "বিষন্ন জোছনা"। বইয়ের নামটি দেখে আপনি হয়তো ধরতে পারবেন না এটি আসলে কোন ঘরনার বই। আঞ্চলিক ভাষায় লেখা "বিষণ্ণ জোছনা" বইটি আমাদের জীবনের গল্প বলে। সম্পূর্ণ উপন্যাসটি একটি নিদিষ্ট আঞ্চলিক ভাষায় লেখা হয়েছে। গল্পের শুরুটা একদমই সাদামাটা হলেও ক্রমেই আপনি পাঠে আগ্রহী হয়ে উঠবেন। একবার পড়া শুরু করলে বইয়ের পরতে পরতে থাকা ভাবধারা আপনাকে ঘিরে ধরবে। আপনি আবিষ্ঠ হয়ে পড়বেন বিষণ্ণ জোছনার মায়াজালে। উপন্যাসটি গড়ে উঠেছে অনেকগুলো চরিত্রকে ঘিরে। বইটি পড়া শুরু করলে একে একে দেখা মিলবে সিরাজ, মিরাজ, জোনাকি, সোনিয়া, মুনিয়া, বায়েজিদ, রত্না, জামান, সায়রা, আম্বিয়া, তারা বিবি,তৌফিক, ইমরান ইত্যাদি চরিত্রের সঙ্গে ।
চরিত্র তৈরি এবং কাহিনীর শাখাপ্রশাখা বিস্তার
উপন্যাসটির শুরু হয়েছে সিরাজ ও মিরাজ দুই ভাইয়ের সম্পত্তি সংক্রান্ত সালিশ-বিচার এর মধ্য দিয়ে। এ-ই সম্পদের ভাগা বাটোয়ারাকে কেন্দ্র করে কাহিনি উত্তরোত্তর শাখাপ্রশাখা বিস্তার করেছে। শুরুটা দেখে মনে হয় খুবই সাধারণ সাদামাটা কিন্তু বর্তমান সমাজের বাস্তব চিত্র কিন্তু এমনি। ঘরে ঘরে এখন সম্পত্তি নিয়ে ঝগড়া, বিবাদ, মারামারি খুনোখুনি লেগেই আছে। গ্রামীণ সমাজের এই
অতি বাস্তব জীবনধারাকে তুলে এনেছেন সাঈদ আজাদ। মাটির জমি আর মাটির দেহের (মানবদেহ) প্রতি মানুষের কি মোহ! কি অকৃত্রিম চাহিদা! লোভ! লালসা! উপন্যাসের শাখা বিস্তার করেছে এই মানুষ আর মাটির মোহকে ঘিরে। উপন্যাসের চিত্রপটে এইসব চিত্র চিত্রিত হয়েছে লেখকের কলম কৌশলে।
যৌনতা এবং যৌবন যে মানবজীবনের এক অপরিহার্য অনুষঙ্গ তা লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন সুন্দর ভাষাশৈলীর মাধ্যমে। লেখকের এই ভাষাশৈলীর জন্য লেখক অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য।
চরিত্র বিশ্লেষণ
"জীবনের জোছনারা কেন স্থায়ী হয় না?" বাক্যটার মাঝে এক বুক হাহাকার! জোনাকির হাহাকার! জোনাকি এ-ই উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র। গল্পে জোনাকির মধ্য দিয়ে এক সরল প্রেমিকার চরিত্রকে চিত্রিত করা হয়েছে। জোনাকি আর তৌফিকের ভালোবাসায় কোন খাদ ছিলো না। তৌফিক হারিয়েও রয়ে গেলো জোনাকির সমস্তকিছুতে। সাধারণত গ্রামের মেয়েদের জীবন যে এমনই হয় আর কি! গ্রামের মানুষেরা এখনও অনেক কুসংস্কার আচ্ছন্ন। খুব সাধারণ ঘটনাকেই তারা তিল থেকে তাল বানিয়ে ফেলে। একটা জীবন নষ্ট করে দিতে পারে এই সব ঘটনার জন্য। তেমন কিছুও ঘটেছিলো জোনাকির জীবনে। সে মানিয়েও নিয়েছিলো বটে। কিন্তু হায়! ভাগ্যের কি নিষ্ঠুর পরিণতি! জোনাকির বিষণ্ণতা পাঠকের মনকে করে তুলবে বিষণ্ন। পাঠকও হারিয়ে যেতে বাধ্য হবে মায়াবী অথচ বিষণ্ণ সেই জোছনায়! হাহাকার করে পাঠকের হৃদয়ও তৌফিকের জন্য বলে উঠবে---
যাকে খুব সহজেই পাওয়া যেত তাকেই দুর্লভ করে ফেলেছে জীবন
নিঃসন্তান আম্বিয়া উপন্যাসের অন্যতম এক চরিত্র। স্বামী সন্তানের ভালোবাসা পায়নি সে। স্বামীর মৃত্যুর পরেও অমানবিক অত্যাচার সহ্য করে স্বামীর বাড়িতে স্বামীর কবরকে আঁকড়ে শুধু স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকে সে।
"মানুষ মরে গেলেএকেবারে হারাইয়া যায় না।কারো না কারো মনে ঠিকইথাইক্যা যায়।"
অপমান আর লজ্জার মধ্যেও জীবিকার তাগিদে এগিয়ে যায় জীবন। কিন্তু বৃদ্ধার মন যে অপমান লজ্জাকে তোয়াক্কা করে না, সে ফিরে আসে তার চিরচেনা সেই গ্রামে। ঘটনা ক্রমে পায় নতুন পরিচয়। ঔপন্যাসিক উপন্যাসের প্রয়োজনে চরিত্রের ভাগ্য পরিবর্তন ঘটান। কিন্তু এ যেন এক বাস্তব চিরচেনা চরিত্র! আমাদের আশপাশেই ছড়িয়ে আছে আম্বিয়ার মতো এমন হতভাগী হাজারো নারী।
এ উপন্যাসের অন্যরকম এবং ইন্টারেসটিং একটি চরিত্র হল বায়েজিদ। কিশোর বায়েজিদের মেয়েদের প্রতি কোন আকর্ষণ বোধ কাজ করে না। যেখানে তার সমবয়সী বন্ধুরা সারাক্ষণ মেয়েদের গল্পে মশগুল সেখানে তার ভালো লাগা কাজ করে ইমরান কিংবা জামানের মতো কোন ছেলের প্রতি। সে সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে চায়। সেও চায় ভালোবাসতে, ভালোবাসা পেতে। কিন্তু তার আকর্ষণ কাজ করে শুধুই ছেলের প্রতি। সে এটাকে অন্যায় ভাবতে থাকে, এক অন্যায় গ্লানিতে ভোগে সর্বক্ষণ। এখানে এই অন্যরকম নতুন চরিত্রটিকে নিয়ে লেখকের সাহসী প্রশংসা করতেই হয়। এমন চরিত্র নিয়ে বাংলা সাহিত্য আছে কি না জানি না, থাকলেও আমি অন্তত পড়িনি বা শুনিনি। এদিক থেকে লেখকের অবশ্যই প্রশংসা করতে হয়। তবে বায়েজিদের এমন নিরব চলে যাওয়াটা স্বাভাবিক লাগেনি। এখানে কাহিনি বড্ড সংক্ষিপ্ত লেগেছে আমার কাছে। আরো কিছু লিখলে উপন্যাসের কোন ক্ষতি হতো না উপরন্তু শ্রী বৃদ্ধি ঘটতো।
বায়েজিদের অনুরূপ চরিত্র জামান। যে একমাত্র বায়েজিদকে বুঝতো, যার কাছে এসে বায়েজিদ নিজের শান্তি খুঁজতো। সামাজিক নিয়মের বেড়ে জামান সুখী করতে চেয়েছিলো সায়রার মতো দুঃখী নারীকে। কিন্তু সায়রার অদৃষ্টে হয়তো সুখ ছিল না অথবা অন্য কিছু..!
বায়েজিদ, জামান, সায়রা,জোনাকি, তৌফিক, আম্বিয়ার মতো জীবনের ট্রাজেডি জানতে হলে পড়ে ফেলুন বিষন্ন জোছনা।
বিষণ্ণ জোছনা ভালোবাসার উপন্যাস। যে ভালোবাসা মানে না নারী-পুরুষ, মানে না কোনো সামাজিক নিয়ম, মানে না কোনো বিধি-নিষেধ। তবুও ভালোবাসার মানুষগুলো আঁটকে যায় সামাজিক নিয়মের বেড়াজালে। কিন্তু ভালোবাসা! তা কি থেমে থাকে? সে এগিয়ে যায় অথৈ বয়ে চলা নদীর মতো।
গ্রামীণ জীবনযাপন, জমি নিয়ে দ্বন্দ, জালিয়াতি, ভাইয়ে ভাইয়ে অশান্তি, প্রেম, ভালোবাসা, বিরহ, বিচ্ছেদ এ-র উপন্যাস বিষণ্ণ জোছনা৷ পিছিয়ে পরা গ্রামীণ মানুষের জীবন পাঠকের মননে নতুন ভাবনা সৃষ্টি করবে। এই উপন্যাস বর্তমান গ্রামীণ জীবন সম্পর্কে মানুষকে অবশ্যই ভাবাবে।
এ উপন্যাসের ধরণ, চরিত্র,পরিবেশ বর্ণনা, শব্দচয়ন, বাক্যগঠন প্রশংসনীয় ছিলো। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠকের মনোযোগ ধরে রাখতে সক্ষম। অভাবনীয় ছিলো কাহিনির শেষটুকু। ঘটনাক্রমে আপনার কাছে পুরো ট্রাজেডি যেন সত্য মনে হবে। কিন্তু একটা সময় পর মনে হয়, একটা পরিবারে, একটা জীবনে এতো সমস্যা একসাথে দেখা দেয় কি? আসলে দেয় বটে! যেন রম্য রোমাঞ্চ নাটকীয়, বিশেষ করে শেষেটা৷ কিন্তু জীবন নাটকের চেয়েও নাটকীয় এতো মানতেই হবে!
রিভিউ : শেখ ফাতিমা পাপিয়া